Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

অশান্ত পশ্চিম এশিয়া থেকে ওঠা আইএস-এর নজরে ভারত

ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর নজরে পড়ছেন কাশ্মীরি যুবকেরা। মাঝেমধ্যে কাশ্মীরের এখানে-ওখানে উড়ছে আইএস-এর পতাকা। উদ্বিগ্ন নরেন্দ্র মোদী সরকার। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সার্বিক পরিকল্পনা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে বিশ্ব-সন্ত্রাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে আইএস-এর নাম।

আবু বকর আল-বাগদাদি।

আবু বকর আল-বাগদাদি।

রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৫ ১৮:০৮
Share: Save:

ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর নজরে পড়ছেন কাশ্মীরি যুবকেরা। মাঝেমধ্যে কাশ্মীরের এখানে-ওখানে উড়ছে আইএস-এর পতাকা। উদ্বিগ্ন নরেন্দ্র মোদী সরকার। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সার্বিক পরিকল্পনা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে বিশ্ব-সন্ত্রাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে আইএস-এর নাম। আইএস-এর বিস্তারে অবাক হয়েছে বিশ্ব। হতচকিত হয়ে পড়েছে মহাশক্তিরা। কিন্তু কী ভাবে সম্ভব হল এই বিস্তার?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে যেতে হবে একটি শয্যার পাশে। যে শয্যায় রয়েছেন আবু বকর আল-বাগদাদি, আইএস-এর স্বঘোষিত খলিফা। মার্কিন বিমান হানায় শিরদাঁড়ায় মারাত্মক চোটে শয্যাশায়ী। মাঝেমধ্যেই মৃত্যুর খবর রটে। তবে এখনও আছেন তিনি। নিজেকে আইএস-এর প্রতি দিনের পরিচালনা থেকে সরিয়ে নিলেও তাঁর সঙ্গে আইএস-এর উত্থান অঙ্গাঙ্গী ভাবে জুড়ে আছে।

পালমিরার সৌধ ধ্বংস, কোবানেতে কুর্দদের হত্যা, তিউনিসিয়ার সুসে, কুয়েতে আক্রমণ— সাধারণের চোখ ধাঁধালেও আইএস কিন্তু স্বভূমে বেশ কিছুটা পিছু হটেছে। ইরাকে সাদ্দামের জন্মস্থান তিকরিত দখল করে নিয়েছে ইরাকি সেনা, শিয়া মিলিশিয়া আর ইরানের ছদ্মবেশী যোদ্ধাদের সম্মিলিত দল। উত্তর ইরাকে কুর্দদের বাধা টপকাতে ব্যর্থ হয়েছে আইএস। হাতে এখন শুধু ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল আর রামাদি। যদিও সিরিয়ায় একটা বড় অংশে আইএস-এর দাপট বজায় আছে, তবুও সিরিয়া থেকে ইরান সীমান্ত পর্যন্ত খিলাফত তৈরির বাগদাদির স্বপ্ন আপাতত অসম্ভবই মনে হচ্ছে। কিন্তু বাগদাদির হাত ধরে আইএস-এর উত্থান, মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতি একটু খেয়াল রাখলে বোঝা যাবে, অসম্ভব বলে এ অঞ্চলে কিছু হয় না। কেন জানতে সাদ্দামের পতনের পরে ইরাকের দিকে ফিরে তাকাই।

সাদ্দামের শাসন শেষ। অনেক দিন পরে শিয়াদের কর্তৃত্ব শুরু। কর্তৃত্বের দাপটে অনিবার্য ভাবে সুন্নিদের সঙ্গে সংঘাত, রক্তস্নান। যে লড়াইয়ের এক অংশ মার্কিন সেনা। সুন্নি ও শিয়া দুই দলের মৌলবাদীরই নিশানায় তারা। কোণঠাসা, বিপন্ন সুন্নিদের মধ্যে অচিরেই জাল বিছায় আল-কায়দা। তৈরি হয় আল-কায়দা ইন ইরাক। এই সময়ে আল-কায়দার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বাগদাদি। নেতৃত্বের স্তরে উঠতে না পারলেও বেশ কয়েকটি হামলার সঙ্গে বাগদাদি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। মার্কিন সেনার কাছে ধরা পড়ে আবু ঘ্রাইবের জেলে বন্দিও ছিলেন বাগদাদি। তার পরে টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস দিয়ে অনেক রক্ত বয়ে গিয়েছে। অসংখ্য প্রাণের বোঝা নিয়ে বিদায় নিয়েছে মার্কিন সেনা। পূর্ণ কতৃর্ত্ব পেয়েছে ইরাকি সরকার, শিয়া আধিপত্য। আর সুন্নি-মানসে আল-কায়দার আধিপত্য। এই সময়েই আবু ঘ্রাইবের জেল থেকে ছাড়া পান বাগদাদি। প্রধানমন্ত্রী মালিকির একবগ্গা শাসনে সুন্নিদের ক্ষোভ চরমে। নিত্য দিন গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ, আত্মঘাতী হামলা চালাতে থাকে আল-কায়দা ইন ইরাক। এই সব হামলার পরিকল্পনায় অংশ নিয়ে দ্রুত নেতৃত্বের উপরের স্তরে উঠে আসেন আল-বাগদাদি।

তবে বাগদাদি-র সামনে সুবর্ণসুযোগ এনে দেয় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সরকারি দমনপীড়নে সশস্ত্র রূপ নেয়। ইরাকের মতো এ ক্ষেত্রেও আলওয়াতিদের প্রাধান্য (যা বকলমে শিয়াদেরই একটি ভাগ) আর বিরোধীরা প্রধানত সুন্নি। আক্রান্ত সুন্নিদের সাহায্যে পশ্চিমী বিশ্ব এগিয়ে এলেও ক্রমেই সুন্নি উগ্রপন্থীরা আসাদ-বিরোধী অভিযানে মূল স্রোত হয়ে ওঠে। আল-কায়দা, আল-নাসিরি ব্রিগেডের মতো সংগঠন শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। বাগদাদি চলে আসেন সিরিয়ায়। সিরিয়ার সুন্নি ‘হার্টল্যান্ড’ রাকা-য় আইএস-এর প্রতিষ্ঠার পিছনে অন্যতম মাথা এই বাগদাদি। ‘আল-কায়দা ইন ইরাক’-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত এই সংগঠনের নেতৃত্ব ছিলেন আবু ওমর আল-বাগদাদি। ২০১০-এ মার্কিন হানায় আবু ওমর-এর মৃত্যু হলে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন আবু বকর। তাঁর নেতৃত্বে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সিরিয়ার পূর্বের বিস্তৃত অংশের দখল চলে আসে আইএস-এর হাতে। এমনকী আসাদ বিরোধী অন্য উগ্রগোষ্ঠীগুলির থেকেও এলাকা দখল করে নেয় আইএস। আর এখানেই ‘মাদার’ সংগঠন আল-কায়দার সঙ্গে আইএসএ-র বিরোধের সূচনা। কারণ, লক্ষ্যের অমিল।

আল-কায়দা পশ্চিমী দেশগুলির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণকে অগ্রাধিকার দেয়। কোনও অঞ্চল অধিকার করে শাসন করা আল-কায়দার দর্শনে নেই। কিন্তু বাগদাদি কঠোর ইসলামিক অনুশাসনে রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনায় আগ্রহী। এ নিয়ে আমন আল জাওয়াহিরি-র সঙ্গে তীব্র বিরোধ, তিক্ততা হয়। শেষ পর্যন্ত আল-কায়দার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন বাগদাদি। জাওয়াহিরিও বাগদাদি-র সমালোচনা করেন। তবে বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন বাগদাদি।

কোনও জঙ্গি সংগঠন চালাতে অর্থ আর লোকবল দরকার। আসাদের বিরোধিতায় লোক জোটাতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু অর্থ? সিরিয়ার পূর্বে আইএস-এর দখল নেওয়া তেলের খনি সে সমস্যা শুধু মেটায়ই না, ভাঁড়ার উপচে দেয়। চোরাবাজারে তেল বেচে দিনে কয়েক লক্ষ ডলার রোজগার করতে শুরু করে আইএস। আর অর্থে কি না মেলে! অত্যাধুনিক অস্ত্র ও লোকবলে দ্রুত ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে আইএস। আপাত অপরিচিত সংগঠনটি কয়েক মাসের মধ্যে বিশ্বের নজর কেড়ে নেয়। শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, পশ্চিমী দেশগুলি থেকেও অনেকে আইএস-এর হয়ে লড়াইয়ে আসেন। মার্কিন সেনার ‘জয়েন্ট চিফ অফ আর্মি স্টাফস’-এর প্রধান জেনারেল মার্টিন ডেম্পসি আইএস-কে এ যাবৎ বিশ্বের সব চেয়ে শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠন বলে স্বীকারও করেছেন।

সিরিয়ার পূর্বে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলের পরে ইরাকের উত্তর-পশ্চিম থেকে ঝড়ের বেগে বাগদাদের দিকে এগোতে থাকে আইএস। বঞ্চিত স্থানীয় সুন্নিদের প্রছন্ন সমর্থন আর ইরাকি সেনার দুর্বল প্রতিরোধ পেরিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে ইরাকের এক-তৃতীয়াংশই আইএস-এর দখলে চলে আসে। সঙ্কটে পড়ে যায় বাগদাদের মালিকি ইরাকি সরকার। অধিকৃত অঞ্চলে নিজেকে খলিফা বলে ঘোষণা করেন বাগদাদি। ইসলামের কঠোর অনুশাসনের বলবৎ করা, সঙ্গে গণহত্যা, নারীদের উপরে অত্যাচার, জোর করে ধর্মান্তরকরণ, পণবন্দিদের মুণ্ডচ্ছেদ, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী (ইয়াজিদি, কুর্দ)-দের উপরে অকথ্য অত্যাচার— ভূরি ভূরি অভিযোগ। ইরাক, সিরিয়ায় ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যের টালমাটাল বেশ কিছু দেশেও আইএস-এর মধ্যেই সংগঠন বিস্তারও শুরু হয়। লিবিয়ায় খ্রিস্টানদের গণহত্যা, সুদূর নাইজেরিয়ার জঙ্গি সংগঠন বোকো হারামের আনুগত্য আদায়।

চরম সঙ্কটে টনক নড়ে বিশ্বের। ইরাকি রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে বিমানহানা শুরু করে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স-সহ আরবের বেশ কিছু দেশের জোট। মাটিতে জোর লড়াইয়ে নামে ইরাকি সেনা, শিয়া মিলিশিয়া, কুর্দ যোদ্ধারা। সুন্নি এবং অন্য সংখ্যালঘুদের ক্ষোভ কমাতে মালিকিকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন আল-আবিদি। আইএস-এর এই প্রসার শঙ্কায় ফেলে ইরানকে। কারণ, সুন্নি আধিপত্য খর্ব করতে সিরিয়ার পাশাপাশি ইরাকেও শিয়া সরকারকে টিকিয়ে রাখা ইরানের পক্ষে জরুরি। শুধু অস্ত্র দিয়ে সাহায্যই নয়, পোষ্য হিজবুল্লার জঙ্গি, ছদ্মবেশে নিজেদের যোদ্ধাদের ব্যবহার করেছে ইরান। যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে ঘনঘন বাগদাদে দেখা যায় ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডের প্রধান কোয়াসিম সুলেইমানিকে। জো়ড়া হানায় পিছু হটতে থাকে আইএস।

কিন্তু এলাকার বিস্তারের চেয়েও দ্রুত ছড়ায় মতাদর্শ। সেই অনুপ্রেরণায় সিডনি, প্যারিস থেকে হালের সুসে— একের পর এক হামলা হয়ে গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকার মতো উন্নত বিশ্বের দেশ থেকে বেশ কিছু যুবক-যুবতী আইএস-এ যোগ দিতে মধ্যপ্রাচ্যে আসছেন। সেই মতাদর্শই এখন ছড়াচ্ছে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত। মহারাষ্ট্রের ১১ জন যুবক আইএস-এ যোগ দিতে ইরাকে পাড়ি দিয়েছিল। সাইবার জগতে ভাবধারা প্রচারের অভিযোগে বেঙ্গালুরু থেকে গ্রেফতার হয়েছিল কলকাতার যুবক মেহদি মসরুর বিশ্বাস। তাই শঙ্কিত মোদী সরকার।

কিন্তু আইএস-কে কি নির্মূল করা সম্ভব? উত্তর না-এর দিকেই ঝুঁকে থাকবে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির জটিল ভারসাম্যে আইএস-এর শক্তি হ্রাস মানে শিয়া, বকলমে ইরানের শক্তি বৃদ্ধি। আইএস-কে দমন করতে গিয়ে ইরাকি সরকার ইরানের উপরে অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যা ইরাকের সুন্নিদের যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ। শুধু প্রাণের ভয় নয়, সামাজিক দিক দিয়ে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ার ভয়ও আছে। এই ভয়ের বাতাবরণই আইএস-এর মতো সংগঠনকে বাঁচিয়ে রাখে।

পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ইরান ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে আমেরিকা-সহ ছ’টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের পরমাণু চুক্তির কাঠামো ঠিক হয়েছে। চুক্তি পালনের প্রতিদানে ইরানের উপরে দীর্ঘ দিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে আমেরিকা, রাষ্ট্রসঙ্ঘ-সহ পশ্চিমী বিশ্ব। আর এই অবস্থায় প্রমাদ গুণেছে সৌদি আরব, কাতার, জর্ডনের মতো সুন্নিপ্রধান দেশগুলি। ফলে ইয়েমেনে শিয়া হুথিদের ঠেকাতে আরব লিগ বোমাবর্ষণ করছে। পাল্টা ইরান হুথিদের সাহায্য করছে। আর এই পুরনো দ্বন্দ্বের ফাঁক গলে টিকে থাকার সুযোগ পাচ্ছে আইএস। পাচ্ছে বিস্তারের সুযোগও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE