Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪

এ কি মার্কিন ভোট, না সারা বিশ্বের!

আমেরিকা কি তার আড়াইশো বছরের ইতিহাসে শেষ পর্যন্ত এক নারীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে? নাকি একজন বর্ণবিদ্বেষী, জাতিবিদ্বেষী, ধর্মবিদ্বেষী কোনও ম্যাজিকে পাশার দান উল্টে দেবেন? একটা রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা আছেই। কিন্তু রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতির ভেতরে কাজ করা লোকজনের বাইরে সেই উত্তেজনা খুব যে বোঝা যাচ্ছে, তা নয়।

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
নিউ ইয়র্ক শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৫২
Share: Save:

আমেরিকা কি তার আড়াইশো বছরের ইতিহাসে শেষ পর্যন্ত এক নারীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে? নাকি একজন বর্ণবিদ্বেষী, জাতিবিদ্বেষী, ধর্মবিদ্বেষী কোনও ম্যাজিকে পাশার দান উল্টে দেবেন?

একটা রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা আছেই। কিন্তু রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতির ভেতরে কাজ করা লোকজনের বাইরে সেই উত্তেজনা খুব যে বোঝা যাচ্ছে, তা নয়। লোকে তাদের বাড়িতে, অফিসে, চার্চে আর সিনাগগে গরম গরম বক্তৃতা শুনছে। এ এম রেডিওতে রাশ লিমবো, ফক্স টিভিতে ও’রাইলি, আর অনলাইন মিডিয়াতে ব্রাইটবার্ট নিউজ তাদের অতি-দক্ষিণপন্থী, প্রায়শ শালীনতা-বিরোধী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে ট্রাম্পের হয়ে। কিন্তু এই সব বৃত্তের বাইরে কেমন যেন একটা নৈঃশব্দ্য। একটা বিপুল অবসাদ। পশ্চিমে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পুবে নিউ ইয়র্ক, উত্তরে মিনেসোটা থেকে দক্ষিণে টেক্সাস— এই বিরাট দেশটার ওপর কে যেন একটা ধূসর চাদর বিছিয়ে দিয়েছে।

কত জন ৮ নভেম্বরের হিমশীতল সকালে বা কাজ থেকে ফেরার পথে শেষ পর্যন্ত তাঁদের কমিউনিটি হল, প্রাইমারি স্কুল বা মিডল স্কুলের বাড়িটায় ঢুকবেন ভোটটা দিয়ে আসতে, এটা কিন্তু এ বার বড় প্রশ্ন। ভোটদানের হারের উপরেই অনেক কিছু নির্ভর করে আছে।

অথচ আমেরিকার এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এক রকম সারা বিশ্বের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মার্কিন জনগণের চিন্তা তো তাঁদের নিজের রুটিরুজি, পরিবার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিয়ে। আর তার বাইরে, তথাকথিত ইসলামি সন্ত্রাস নিয়ে। যে সব ব্যাপারে ট্রাম্প আর পাঁচটা অতি-জাতীয়তাবাদী, যুদ্ধবাদী রাষ্ট্রনায়কের মতোই কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন। বলির পাঁঠা খাড়া করেছেন এক দিকে মুসলিমদের, আর অন্য দিকে গরিব অভিবাসীদের। জনরোষকে ঘুরিয়ে দিচ্ছেন সমস্যার আসল কারণ থেকে। তিরিশের দশকের জার্মানির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে অনেকেরই।

এই কৃষ্ণাঙ্গ আর গরিব অভিবাসীরাই কিন্তু ওবামাকে বিশাল ভোটে জয়ী করেছিলেন। শ্রমিক ইউনিয়নের একটা বিরাট অংশের ভোট চিরকাল ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের দিকে গিয়েছে। এ বারও তাঁরা যদি বিপুল সংখ্যায় রাস্তায় বেরিয়ে এসে ভোট দেন, তা হলে হিলারির জয়লাভ আমার মতে সুনিশ্চিত। আমেরিকার মুসলিম নাগরিকরা, একেবারে হাতে গোনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, কেউ ট্রাম্পকে ভোট দেবেন না— এ কথা আমি প্রতিদিন শুনছি আমার বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি বন্ধুদের কাছে। আমাদের ব্রুকলিনে বাস করা সেনেগাল, নাইজেরিয়া, সুদান আর ইথিয়োপিয়ার মুসলিমদের কাছে। কিন্তু সমস্যা হল মুসলিমদের মধ্যে মার্কিন নাগরিকের, বিশেষ করে রেজিস্টার্ড ভোটারের সংখ্যা নগণ্য।

অভিবাসীদের মধ্যে মেক্সিকান এবং ল্যাটিনোরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। ট্রাম্পের অভিবাসী-বিদ্বেষী অবস্থানের কারণে তাঁদের ভোটও হিলারির দিকেই যাবে। মুশকিল হল, তাঁদের মধ্যেও একটা মেরুকরণ আছে। মুসলিম-বিরোধী প্রোপাগান্ডা তাঁদের মধ্যে একটা রক্ষণশীল অংশকে ট্রাম্পের দিকে ঠেলে দেবে না, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ, সত্যি কথা বলতে পরিচয়হীন, গরিবের গরিব হিসপ্যানিক অভিবাসীরা— যাঁরা বিদ্বেষ, বৈষম্যের সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছেন— তাঁদের ভোট নেই। তাঁরা নাগরিক নন। এবং তাঁদের কথা ভাবার সময় বেশির ভাগ নাগরিক ও মোটামুটি সম্পন্ন অভিবাসীদের নেই।

শ্রমিকদের পড়ানোর কাজে যুক্ত থাকার সুবাদে জানি, আমার নিজের লেবার ইউনিয়নেই বলতে গেলে নব্বই শতাংশ চিরকাল ডেমোক্র্যাটদেরই ভোট দিয়ে এসেছেন। রোনাল্ড রেগানের সময় থেকে আমেরিকার সম্পদ ও উপার্জনে বৈষম্য খুবই বেড়ে গেছে। সেটা শ্রমজীবী পুরুষ, নারী ও শিশুদের স্পর্শ করেছে সবচেয়ে বেশি। রেগান ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং অতিধনিক ব্যক্তি ও কর্পোরেশনগুলোর ক্ষমতা সীমাহীন হয়ে পড়েছে। আজ আমেরিকায় বিশাল বিশাল বহুজাতিক কর্পোরেশনের সিইও’রা যা উপার্জন করেন, আজ থেকে তিরিশ বছর আগে তা আমেরিকাতেও অকল্পনীয় ছিল। উৎপাদনের বেশির ভাগটাই চলে যাচ্ছে চিন, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, কোরিয়া, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকায়। আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষ তাই ভয়ঙ্কর হতাশাগ্রস্ত। সেই হতাশা থেকে জন্ম নিচ্ছে ক্রোধ। সেই ক্রোধ যে ব্যালট বাক্সে ট্রাম্পের দিকে যাবে না, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট, দুই পার্টিই এই অর্থনৈতিক হতাশা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের এই শ্রমিক ইউনিয়নে কট্টর ডেমোক্র্যাট ভোটারদের মধ্যেও বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ ট্রাম্পকে ভোট দেবেন, এ কথা আমি প্রতিদিন তাঁদের সঙ্গে কথা বলেই বুঝতে পারছি।

আমি বহুকাল ধরে এ দেশে মূলস্রোত রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছি। কাজ করেছি মানবাধিকার নিয়ে। বিশেষ করে ভারতীয় ও বাঙালি অভিবাসীদের সঙ্গে খুবই ওঠাবসা করেছি। তাদের মধ্যে এ বারের নির্বাচনকে ঘিরে একটা মেরুকরণ লক্ষ করছি, যা আগে দেখিনি। ওবামার ২০০৮ সালের প্রথম নির্বাচনে বাঙালি আর ভারতীয় আমেরিকানরা, যাঁদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গপ্রেম বিরল, তাঁরাও মোটামুটি ভাবে ওবামাকেই ভোট দিয়েছিলেন। তার একটা কারণ বোধহয় এই যে, বুশের ভয়ঙ্কর ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে এ দেশে যে জনমত জাগ্রত হয়েছিল, তার মানবিক উত্তাপ তাঁদেরও স্পর্শ করেছিল।

আজ কিন্তু হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় ভোটাররা ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার জন্যে জোর প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ ট্রাম্পের মুসলিম-বিরোধিতা তাঁদের দর্শনের সঙ্গে মেলে। রিপাবলিকান পার্টি এখনই আমেরিকার কংগ্রেসের— অর্থাৎ হাউস অব রেপ্রেজেন্টেটিভস ও সেনেটে— ক্ষমতায় আছে। এখন এক জন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট হলে সারা বিশ্বে যে কী অর্থনৈতিক ত্রাস ও যুদ্ধের নতুন আতঙ্ক সৃষ্টি হবে, তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না বা বুঝতে চাইছেন না।

কিন্তু এ সব কিছু মিলিয়েও, আমার মনে হয়, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম। নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, ইলিনয়, কলোরাডোর মতো বড় রাজ্যগুলোতে যদি প্রত্যাশামাফিক হিলারি ক্লিন্টন জেতেন, তা হলে দক্ষিণের রক্ষণশীল রাজ্যগুলোয়— যেমন টেক্সাস, জর্জিয়া, ফ্লোরিডা— ট্রাম্প জিতলেও ম্যাজিক নাম্বার অর্থাৎ ২৭২ ইলেক্টোরাল ভোট পেতে হিলারির অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।

আমরা অপেক্ষা করে আছি। হিলারির জেতার জন্য তত নয়, অনেক বেশি করে ট্রাম্পের হার দেখার আশায়।

অন্য বিষয়গুলি:

Donald Trump Hillary Clinton
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE