দুর্গাপুজোর মধ্যে দিয়ে যেন উৎসবের মরসুম শুরু হয় এ মুলুকে। —ফাইল চিত্র।
সাঙ্গ হল উৎসবের পালা। কালীপুজো শেষ, এ বার দু’দণ্ড নিশ্চিন্তি, মাস চারেকের ফুরসত। মার দ্বিতীয় কন্যাটির আসতে আরও বেশ কিছু দিন, তত দিনে শীত কাবার। কিন্তু সে তো আমাদের ধনধান্যে পুষ্পভরা বসুন্ধরার কথা, এ মুলুকে তেমনটি মোটেও নয়। দুর্গাপুজো এখানে উৎসবের প্রিলিউড বলা যেতে পারে। সে মহাযজ্ঞির কথা তো কয়েক দিন আগেই লিখলাম! ভারতের অন্য প্রাদেশিকদের তুলনায় বাঙালি তো সংখ্যালঘু। কিন্তু পুজোয় ধুতি-পাঞ্জাবি-জামদানি-কাঞ্জিভরমে বাবুবিবির সংখ্যা গুনলে চমকে যেতে হয়, এতো বঙ্গসন্তান এখানে থাকে নাকি! অশনে-ব্যসনে-ভূষনে-বসনে পুজো উইকএন্ড তো মহাসমারোহে কেটে যায়। কলকাতায় তো মোটে চার দিনের পুজো, আর এখানে প্রায় তিন সপ্তাহ! কলকাতার পুজোকে মাঝখানে রেখে এখানকার পুজো কমিটিগুলো আগে পরের উইকএন্ড-এ ভাগ করে নেয়, এ সপ্তাহে এ পাড়া তো পরের সপ্তাহে অন্য পাড়া, সে ভারী মজার ব্যাপার! বিজয়া হয়ে যাওয়ার পরও আগে যেমন কলকাতার অনেক মণ্ডপে ঠাকুর থেকে যেত অনেক দিন, অনেকটা তেমনই। সে যা-ই হোক, মায়ের পায়ে পায়ে চলে আসে লক্ষ্মীঠাকুরুন। সে তো নেহাতই ঘরোয়া ব্যাপার। যদিও কল্লোল-এর লক্ষ্মীপুজোতেও জড়ো হয় প্রায় দু’-তিনশো বাঙালি। একসঙ্গে খিচুড়ি লাবড়া খাওয়া বা ঘরোয়া জলসা শোনা, তাই বা কম কি! অতঃপর ভাইফোঁটা। নিজের ভাইকে ফোঁটা দেওয়ার সৌভাগ্য কারওরই প্রায় হয় না বিশেষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে হাতের নাগালে থাকে না, তুতোভাই একটি দু’টি যদি বা এ দিক-ও দিক থেকে থাকে, ফোঁটা দিয়ে ওঠা হয় না হয়তো নানা জটিলতায়। তাই বরের বন্ধু বা বন্ধুর বর, ভাই পাতিয়ে নিলে ক্ষতি কি! সেটাই তো লাভ! পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা, নতুন সম্পর্ক গড়ে, ভাইফোঁটার মাধুর্য বাড়ে! এরা পরকে আপন করে...
আরও পড়ুন: দেশের এই জলপ্রপাতগুলি না দেখলে মিস করবেন
এ বার আসি কালীপুজোর কথায়। সে তো আর কথা নেই, ২০১৭-তে এসে সে প্রায় রূপকথা হয়ে গিয়েছে। এ বছরই নিউ জার্সিতে আইনসঙ্গত হয়েছে বাজি পোড়ানো। ওরে পাগলা সাঁকো নাড়াসনে- বাংলার এ প্রবাদবাক্য এই সাহেবগুলানকে কেউ শোনায়নি, খাল কেটে কী কুমির ঢুকিয়েছে বেচারারা বুঝতেই পারল না! ওক ট্রি নামক একটি ভয়ানক দিশি রাস্তা যেখানে সাহেবসুবোরা পারতপক্ষে পা রাখে না, ভয়ে ভয়ে এ পাশ-ও পাশ দিয়ে যাতায়াত করে, কোনও ভাবে ঢুকে পড়লে চোখ বুজে খ্রিস্টনাম করতে করতে পার হয়ে যায়। সে রাস্তায় প্রায় শ্যামবাজার হাতিবাগানের ফুটের দোকানের মতো ঢেলে বাজি বিক্রি হয়েছে। কসকো— একেবারে খাঁটি মার্কিন হোলসেলার চেন, দ্যাখ না দ্যাখ চোখের নিমেষে বাজি উধাও। বুড়িমার চকোলেট বোমা বা সাপবাজি, কোনও একটা আমদানি করে ফেলতে পারলেই এ দিশিরা প্রাণ হাতে নিয়ে পালাতে পথ পাবে না এ দিনটা চোখের সামনে দিব্য দেখতে পাচ্ছি। আহা! বর্ণে গন্ধে ‘শব্দে’ গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা!
বরফের মরসুম সামনেই। নিউজার্সি এ বার সান্তাবুড়োর জন্য কাউন্টডাউন শুরু করে দিয়েছে। ছবি: পিক্সাবে।
তো যে কথা বলছিলাম, কালীপুজো পার করেই কিন্তু উৎসবের শেষ নেই এখানে। আমাদের তেরো পার্বণ ছাড়াও আরও বারো লোকাল পার্বণ হল বছর শেষের বোনাসের মতো। আর আমাদের বাঙালির তো অন্যের উৎসব আপন করে নিতে জুড়ি নেই। এক বন্ধু লিখেছিল ফেসবুকে, বেশ মনে ধরেছিল কথাটা, আমরা যেমন রঙ্গোলিকে আপন করে নিয়েছি, তেমন করে যদি আমাদের অবাঙালি বন্ধুরা বাংলার চালের গুঁড়োর আল্পনাকে আপন করে নিতে পারত! সে যাক, ধনতেরাস, ডান্ডিয়া, করভাচৌথ— আমরা কীসে নেই! তো এদের ভুতের কেত্তন আমরা মাথায় করে রাখব না!! পৃথিবীর ধনীতম দেশ নাকি! রাস্তায় দিনে কোথাও মনুষ্যচরিত্র দেখা যায় না, হুশহাস করে গাড়ি যায় শুধু! রাতেও সব অন্ধকার, ছায়া ছায়া, রাস্তায় একটু জোরালো আলো দিতে এদের যে কী সমস্যা হয় কে জানে! এ দেশে এসেই এক বার জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার কর্তাকে, তার আবার এ দেশে বিশ বছর বছর হয়েছে কি না, যুক্তিবুদ্ধিগুলোও এখানকার স্থানীয়দের মতো একটু ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে! গম্ভীর মুখে সবজান্তা ভাব নিয়ে বলল, রাস্তার জোরালো আলো গাড়িচালকদের চোখে পড়ে মনোযোগ বিঘ্নিত করে, গাড়ির হেডলাইটকে ডাইলিউট করে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটাতে পারে, তাই এই সায়েন্টিফিক ব্যবস্থা। বলাই বাহুল্য, আমার তিন বছরের মেয়েটাও এমন সায়েন্টিফিক লজিক শুনলে ফিক করে হেসে ফেলত। এমনিতেই তো অদ্ভুতুড়ে একটা দেশ, তোরা আবার ভুত সাজাস কোন আক্কেলে! সে কি সাজ! কোথাও বাড়ির বারান্দায় মামদো ভুত সপরিবার ডিনারে বসেছে তো কোথাও ব্রক্ষ্ম ভুতের ছানা কাটা মুন্ডু নিয়ে ডাংগুলি খেলছে। পুরো একেবারে ভুতেদের ঝুলন মেলা! আমরা উদারচরিত বাঙালি পরম মমতায় হ্যালোইনকেও আপন করে নিয়েছি। হ্যালোইন পার্টিগুলো তে নাকে চোখে মুখে লাল তিলক কেটে রক্তচোষা ড্রাকুলা সেজে হাজির হয়ে যাই পরম উৎসাহে। কি আর বলি, আমার বাড়ির বারান্দাতেও গোটা হ্যালোইন পরব জুড়েই কোট প্যান্টুল হ্যাট পরা ভুত বসে দিবারাত্র গিটার বাজায় আমার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও। হে ভগবান এ পরবাসে রবে কে!
আরও পড়ুন: শিমলা-চেইল-সারাহান-সাংলা-ছিটকুল
তেনাদের নিয়ে আদিখ্যেতাটা আমার নাপসন্দ হলেও বারো মাসে তেইশ পার্বণের হুল্লাটটা মন্দ লাগে না বটে। দিনগুলো কেমন হুশ করে কেটে যায়। মনখারাপের বুদবুদগুলো মনের কোনও কোণে লুকিয়ে থাকে, দিনযাপনে তার লম্বা ছায়া ফেলার অবকাশ হয় না। এই প্রবাসে বোধহয় সবাই একা হয়ে যাওয়ার ভয় পায়, তাই একে অপরকে জড়িয়ে নানা উপলক্ষ তৈরি করে হইহল্লোড় করে দিনগুলো কেটে যায় বেশ। এই তো হ্যালোইন থ্যাঙ্কসগিভিং-এর লম্বা উইকএন্ড পার করেই বড়দিনের প্রস্তুতি। সেই তো এ মুলুকের আসল উৎসব। একটা মাস অন্তত গোটা দেশটা আলো ঝলমলে। তবে ভুত সাজাতে এদের আইডিয়া যেমন খেলে, বড়দিনে আলোকসজ্জায় তার কিছুটাও যদি দেখতাম! ইচ্ছে করে একবার এদের আমাদের চন্দননগরটা ঘুরিয়ে আনি জগদ্ধাত্রী পুজোর সময়!
দ্যাখো রে নয়ন মেলে, আলো কাকে বলে!
তবে এই বদনাম ঘুচিয়ে দেয় নিউইয়র্কের ক্রিসমাস বা নিউইয়ার ইভ সেলিব্রেশন, টাইম স্কোয়ারের আলোর রোশনাই— তার সাক্ষী তো গোটা বিশ্ব। আপাতত এখানে বড়দিনের প্রস্তুতি শুরু। আর বড়দিন তো শুধুই একটা বিচ্ছিন্ন উৎসব নয়, বড়দিন মানে একটা গোটা বছরের হিসেবনিকেশ। হারানো-প্রাপ্তি, চাওয়া-পাওয়া, মান-অভিমান, টুকরো টুকরো কত মুহূর্ত ভালবাসার বেদনার...
২০১৭ ভাল কাটেনি পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই। কত কিছু হারালাম আমরা। ডেবিট অ্যাকাউন্টটা এ বছরে বড্ড ভারী হয়ে গিয়েছে। কে জানে নতুন বছরটা আবার কী নিয়ে আসছে! কাউন্টডাউন শুরু, সান্তাবুড়োর কাঁধে চেপে বরফসাদা বড়দিনের আর তার পায়ে পায়েই নতুন বছরের। আর তো হাতে গোনা কয়েকটা দিন।বছরের বাকিটুকু পার হয়ে যাক সবার ভালয় ভালয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy