আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি।
গ্রামের কুঁড়ে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বিদেশি টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন কৃষক আলি নিনো। বলছিলেন, ‘‘এই যে দেখছেন বিস্তীর্ণ প্রান্তর, নানা ধরনের আকেসিয়া এবং গাও গাছে ভরা, ৪০ বছর আগেও এই দৃশ্য কল্পনা করা যেত না। আশির দশকে, যখন আমরা শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিয়েছি, তখন আমাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না যে, সাহারা মরুভূমির ছোঁয়া লাগা আমাদের এই ঊষর, প্রাণহীন গ্রামে কোথাও সবুজের ছোঁয়া লাগতে পারে। কিন্তু আমাদের চোখের সামনেই পাল্টে গেল ছবিটা।’’
আলি নিনো মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকার অত্যন্ত দরিদ্র দেশ নিজ়েরের বাসিন্দা। এই দেশের আশি শতাংশই সাহারা মরুভূমির অংশ। বাকি অংশে কিছুটা চাষবাস হত। কিন্তু চাষের জন্য সব গাছ কেটে ফেলার কারণে, আর সরকারের নতুন গাছ লাগানোর পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পরে পরিবেশগত ভারসাম্য প্রায় ভেঙে পড়েছিল দেশটিতে। আশঙ্কা করা হচ্ছিল, এ বার মরুভূমি পুরোপুরি গ্রাস করে নেবে এই দেশকে।
নিজ়েরের উত্তর দিকটা সাহারার অংশ, তাই দক্ষিণে নাইজার নদীর কাছের সবুজ অঞ্চলেই বরাবর মানুষের বসবাস বেশি ছিল। কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন তাঁরা। গাছ থেকে জ্বালানির কাঠ কেটে নিলেও কাটা জায়গা থেকে নতুন ডালপালা বেরিয়ে গাছ ফের বড় হয়ে যেত। এখানে বসবাসকারী মানুষেরা প্রকৃতিকে, তার সম্পদকে নিজের মতো করে রাখতে ও বাড়তে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ফরাসি উপনিবেশকারী শাসকেরা ‘লাভজনক’ বাদামের চাষ করার জন্য চাষের জমি বাড়াতে নিজ়েরের প্রায় সব গাছ কেটে ফেলে। সেই ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্তের
ফল— গ্রীষ্মকালে প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যেত নিজ়েরের ‘ঊর্বর’ এলাকার তাপমাত্রা।
১৯৬০ সালে স্বাধীন হল দেশটি। কিন্তু বছরের পর বছর তীব্র খরার ফলে নদী-সহ জলের সমস্ত উৎস শুকিয়ে যেতে শুরু করল এবং প্রচণ্ডভাবে নেমে যেতে শুরু করল মাটির নীচের জলস্তর। যার ফলে কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল, শুরু হল দুর্ভিক্ষ। যে-টুকু গাছ বাকি ছিল, জ্বালানি হিসাবে বিক্রি করার জন্য তা-ও কেটে নেওয়া শুরু করলেন দরিদ্র মানুষেরা।
১৯৮০-র দশকের প্রথম দিকে নিজ়েরে বসবাসকারী টনি রিনাউডো নামের এক অস্ট্রেলীয় কৃষিবিদ খেয়াল করে দেখেন যে, কেটে ফেলা গাছের গুঁড়ি থেকে ডালপালা বড় হচ্ছে, এবং তার আশেপাশে চাষ করলে মিষ্টি আলু, ওল, জোয়ার বা বাজরার ফসল দ্বিগুণ হচ্ছে। কয়েকটি গ্রামের অভিজ্ঞ কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে টনি বুঝতে পারেন, তাঁরাও কৃষিজমির এই পরিবর্তন খেয়াল করেছেন। বছর গড়াতে থাকল এবং পূর্বজদের পোঁতা স্থানীয় গাও গাছগুলোকে বাড়তে দিয়ে কৃষকেরা বুঝতে পারলেন, গাছের শিকড় মাটিকে স্থিতি দিচ্ছে, কারণ গাও বা ‘উইন্টারহর্ন’ গাছগুলোর শিকড় তার ডালের চেয়েও বড়। এর ফলে সাহারা থেকে আসা বালির ঝড় মাটিকে আলগা করতে পারছে না। তার শিকড় বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে মাটিকে পুষ্ট করছে। আবার গাছ থেকে পড়া পাতা এবং ডালপালায় জমি আরও পুষ্ট হচ্ছে। গাওয়ের ছায়ায় বেড়ে ওঠা জমিতে ফসল ফলছে অনেক গুণ বেশি। এই শিক্ষা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, কৃষকদের মধ্যে যেন এক নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে গেল। একরের পর একর জমিতে নিজেদের মাটিতে হওয়া গাও-এর মতো গাছদের বাড়তে দিয়ে পাল্টে গেল একটি ঊষর হয়ে যাওয়া দেশের মুখ। পরিবেশবিদদের মতে, দক্ষিণ নিজ়েরের কৃষকেরা গত তিন দশকে অন্তত ২৫ কোটি গাছ লাগিয়েছেন। এখন কোনও বছর বৃষ্টি কম হলেও তাঁরা জানেন, এই গাছের ছায়ায় জমিতে ফসল ফলবে। ২০১১-২০১৫-র তীব্র খরাতেও দক্ষিণ নিজ়েরে ফসল ফলেছে যথেষ্ট। জলস্তর বেড়েছে, গবাদি পশুর সংখ্যাও বেড়েছে। আর এই শিক্ষা ছড়িয়ে পড়েছে পড়শি দেশগুলিতে— মালি, নাইজেরিয়া, বুরকিনা ফাসো, এমনকি পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও। এ ভাবেই সবুজ হচ্ছে নিজ়ের ও তার দেখানো পথে চলা আফ্রিকার অন্য দেশগুলি। তৈরি হচ্ছে এক ‘সবুজ প্রাচীর’ যা সাহারা মরুভূমির অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে।
গাছেরা বাড়ছে। নিঃশব্দে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy