ছবি: রয়টার্স।
ফিলাডেলফিয়ায় এখন পাতা ঝরার মরসুম। পরিচ্ছন্ন শহরের গাছগুলো থেকে রঙ চুইয়ে ফুটপাথে এখন বাহারি ক্যানভাস। আর ঝরা পাতার খসখস শব্দে নীরবে মিশছে ভোটের রঙ। পথের ধারে ধারে রেস্তোরাঁ,কফিশপ। বাইরে কনকনে হাওয়ায় কফিমগ হাতে বসে থাকা নীচুস্বরে কথা বলা মানুষজন।
দেশে পাড়ার চায়ের দোকানের কথা মনে পড়ছিল। ভোটের আগে কত আড্ডা, তর্কবিতর্ক। সক্রিয়ভাবে যোগ না দিয়েও মন দিয়ে শোনা যেত নানা মুনির নানা মত। এ দেশেও যদি তেমন সুযোগ পাওয়া যেত! পরিচিত মানুষজন ছাড়া হঠাৎ ভোটের আড্ডা জমানো যায় না এ দেশে। আড্ডা হতে পারে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে। তাই সই।
এলিন কার্ডিলো গবেষণা করেন পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। মানুষের চেতনার সঙ্গে তাঁর গবেষণার গভীর যোগাযোগ। আমার সঙ্গে তার ছিটেফোঁটাও নয়। তবু আলাপের পরে ভোটের হালচাল নিয়ে খোঁজ করলাম। এক জন আমেরিকান মহিলা এই নির্বাচনকে কী চোখে দেখছেন— এতেই আমার কৌতূহল জানতে পেরে আড্ডা জমে গেল। কথায় কথায় জানলাম, রাজনীতিতে ততটা আগ্রহ না থাকলেও হিলারি প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনায় এখন তিনি ভোটের খবরের আগ্রহী পাঠক-দর্শক। উঠে এল সমীক্ষার কথা। প্রার্থীদের ওঠাপড়ার কথা।
শুধু এলিন নন, আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে হিলারিকেই যে ক’দিন পরে ওভাল অফিসে দেখার সম্ভাবনা প্রবল, সে কথা প্রায় সবক’টি সমীক্ষাই বলতে শুরু করেছে। হিলারির ই-মেল নিয়ে এফবিআই ফের তদন্তের ঘোষণা করায় কী হয় কী হয় একটা ভাব তৈরি হয়েছিল। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর ব্যবধান কমে আসায় আমেরিকার শেয়ারবাজারে ধস নামে। যদিও সেটা সাময়িক। দিনদুয়েক পরেই বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা গেল, ওয়েলেসলি কলেজের এই স্নাতকের উপর তেমন প্রভাব পড়েনি। ফের ঘুরে দাঁড়ায় বাজার। হয়তো হাঁফ ছাড়েন হিলারিও।
তবু অনেকের মতো এলিনের মনে প্রশ্ন জেগেছিল? সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কাতেই কি সূচকে থরহরি কম্প!
‘আসলে কী জানেন চোরাস্রোত আছেই। আমার মনে হয় সেই চোরাস্রোতই এ বারের নির্বাচনকে একপেশে হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। নইলে যুক্তির ছুরিতে এ বারের নির্বাচনকে ফালাফালা করলে দেখা যাবে, নির্বাচন তেমন বিতর্কিত হওয়ার কথা ছিল না।’
সে কথা ঠিক। একেবারে গোড়া থেকে ভাবলে, হিলারির প্রার্থী হওয়া নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা কোনও দিনই ছিল না। অর্থাৎ দলের ভেতরে তাঁকে তেমন বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়নি। হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভে ডেমোক্র্যাট দলের শক্তিও যথেষ্ট। সেটাও দলের পক্ষে সুলক্ষণ। ওবামা কেয়ার নিয়ে দেশের আনাচে কানাচে ক্ষোভ যদিও ছিল। তবু একথা বলতেই হচ্ছে, দু’টি মেয়াদ ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসাবে কাটিয়ে দেওয়ার পরে দেশব্যাপী যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তৈরি হওয়ার কথা ছিল তা-ও হয়নি। তার একটা কারণ বোধহয়, মোটামুটি বড়সড় ঘটনা ছাড়াই নির্বিঘ্নে কার্যকালের মেয়াদ তিনি পেরিয়েছেন। জঙ্গি হামলা, অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা যুদ্ধের মতো গম্ভীর পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বা বিদেশনীতিতেও তেমন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি ডেমোক্র্যাটদের।
তা ছাড়া শিক্ষাদীক্ষায় উজ্জ্বল হিলারির গ্রহণযোগ্যতাও কম নয়। রাজনীতিতে অভিজ্ঞ। বিদেশ দফতর সামলেছেন। তুলনায় ট্রাম্প অনেক নিষ্প্রভ। সফল ব্যবসায়ী। ধনকুবের। এই পর্যন্তই। জাতীয় স্তরে তাঁর তেমন গুরুত্ব আগে ছিল বলে মনে হয় না। তবে রাজনীতিতে যাদের অনীহা রয়েছে, তাঁদের মনে ট্রাম্প কিছুটা কৌতূহল জাগিয়েছেন। যত দিন গিয়েছে, ট্রাম্প তাঁর বিতর্কিত মন্তব্যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় অতি সক্রিয়তায়, নারীঘটিত নানা কাণ্ডকারখানার মুখরোচক খবরে দ্রুত বিতর্কিত হয়ে উঠেছেন।
প্রশ্ন হল, হিলারির পথ যদি এতই প্রশস্ত ছিল তবে এই জমজমাট লড়াইটা তৈরি হল কীসে? এখানকার ভোট বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এখানেই এ বারের ভোটের বিশেষত্ব। সরাসরি সমর্থনের চেয়েও এবার প্রার্থীদের বড় মূলধন প্রতিপক্ষের বিরোধিতাজনিত পরোক্ষ ভোট। ট্রাম্পের সমর্থনে তাঁরাই জড়ো হয়েছেন, যারা হিলারিকে চান না।
যাইহোক, ‘নেগেটিভ ভোটিং’য়ের সেই হাওয়াটা দু’পক্ষই বুঝেছিল। আর সেখান থেকেই বোধহয় কাদা ছোড়াছুড়ির শুরু। সেটা পর্যায়ক্রমে নেমে এল ব্যক্তিগত কেচ্ছায়। সেটা দুনিয়ার চোখে এ বারের নির্বাচনকে একদিকে যেমন খাটো করেছে, তেমনই বাড়িয়ে দিয়েছে মানুষের কৌতূহল। বুক ঠুকে আর কে কবে বলেছে, কেচ্ছায় কৌতূহল নেই।
বলি, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নারীঘটিত নানা প্রচারকে সংযতভাবে কাজে লাগিয়েছেন হিলারি। মহিলাপ্রার্থী হওয়ার সুবাদে সেই প্রচারের অভিঘাত কিন্তু মামুলি হওয়ার কথা নয়। তার প্রভাবে এবার ভোটারদের মধ্যে নারী-পুরুষের মেরুকরণ ঘটবে না তো! আমেরিকান মহিলারা কী ভাবছেন?
উত্তরে এলিন যে ভাষায় তিনি আমেরিকার পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণ করলেন, এককথায় তা বিস্ময়কর। ‘মহিলাদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার ব্যাপারে এখনও দেশটার দ্বিধা রয়ে গিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনেক মন্তব্যেই এটা স্পষ্ট, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা তাঁর নেই। মুশকিল হচ্ছে এ দেশের বহু মানুষের মনের কথারই প্রতিধ্বনি করছেন ট্রাম্প। অর্থাৎ এখানকার সামাজিক ব্যবস্থাতে ভণ্ডামিটা রয়ে গিয়েছে। তাই এ দেশের মহিলারা ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার আগে দু’বার ভাবছেন। তাঁদের মধ্যে রিপাবলিকান মহিলাদেরও বড় অংশই রয়েছেন বলে আমি জানি।’
এলিন মনে করেন, হিলারি এলে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতিকেও নিয়োগ করবেন তিনি। এমন কাউকেই নিয়োগ করবেন যাতে নারীর অধিকার রক্ষায় তা সহায়ক হবে।
ঘুরে ফিরে হিলারিই আসছিলেন আলোচনায়। সুযোগ পেয়ে বলি, আমাদের দেশ কিন্তু অনেক আগেই সর্বোচ্চ পদে একজন মহিলাকে বসাতে পেরেছিল। শুধু ভারত নয়, উপমহাদেশের আরও অনেক দেশেরই নাম করা যায়। এবার হিলারি যদি প্রেসিডেন্ট হনও, এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে আমেরিকার কি একটু দেরি হয়ে যাবে না? বিশেষত, আমেরিকার মতো দেশ যারা নারী-পুরুষ সমান অধিকারের কথা বলে। সাম্যের কথা বলে!
দেখলাম বিষয়টা নিয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতন। তার কথায়, দেরিতে হলেও হোক।
হিলারিকে সামনে রেখে এ বার নারীমুক্তির নতুন সংজ্ঞা খুঁজছে আমেরিকা। স্বপ্ন দেখছেন এলিনের মতো মহিলারা। হিলারি তাঁদের কাছে অনুপ্রেরণা।
সময় হল ওঠার। জিজ্ঞাসা করলেন, দ্য সিক্রেট প্রেসিডেন্সি অফ এডিথ উইলসন’ বইটা পড়েছি কি না! সবিনয়ে জানাই, না। ফিরে এসে নেট ঘাঁটাঘাঁটি করে সন্দেহ হল হিলারি যদি শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউসে ঢোকার সুযোগ পান তাহলেও তাঁকে আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট কি বলা যাবে! সেখানে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছেন আরেক মহিলা। তা-ও প্রায় একশো বছর আগে। একদা আমেরিকার ফার্স্টলেডি হিলারি যে সম্মান পাবেন কি না তা নিয়ে গোটা বিশ্ব তোলপাড়, সেটাই কার্যত পেয়েছিলেন উড্রো উইলসনের দ্বিতীয় স্ত্রী, আরেক ফার্স্টলেডি জেডিথ।
প্রায় ১৭ মাস ওভাল অফিস সামলেছিলেন। প্রথাগত শিক্ষা ততটা ছিল না এডিথের। কিন্তু বিচক্ষণতায় সমস্ত খামতি পুষিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯১৯ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট উড্রো পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে যান। সেই থেকে তাঁর কার্যকালের বাকি সময়টুকু এডিথই সামলান প্রেসিডেন্টের যাবতীয় দায়িত্ব। তবে সেই খবর খুব বেশি মানুষ সে সময় জানতেন না। জানার কথাও নয়। একশো বছর আগে সাংবাদিকতা তার একপেট খিদে নিয়ে ছটফট করত না। কাজেই প্রেসিডেন্টের প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস মাপার রেওয়াজ তখন ছিল না। টেলিভিশনের দাপাদাপি তো দূরস্থান। বইটিতে লেখক আর্থার উইলিয়াম হ্যজেলগ্রোভ ‘ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট’ এডিথের কার্যকালের বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। কী ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন তিনি, কেমন করে সামলাতেন তাবড় কূটনীতিকদের। চাট্টিখানি কথা নয়। তা-ও আবার যে সে নয় পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী পদে!
হ্যজেলগ্রোভের দাবি, হিলারি যদি নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট হনও তবু তাঁকে আমেরিকার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট বলা যাবে না।
আরও পড়ুন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy