বিধ্বংসী: ঘূর্ণিঝড় ইডা-র তাণ্ডবের পর আমেরিকার লুইজ়িয়ানার একটি বন্দরের চিত্র। শনিবার। পিটিআই
তেরো বছর এ শহরে আছি। নিউ ইয়র্কের এমন রূপ দেখব, কখনও ভাবিনি।
আমি থাকি ম্যানহাটনে। শহরের এই এলাকা হারিকেন ইডা-র তাণ্ডবে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া বা টিভি খুললেই নিউ ইয়র্কের যে ছবি দেখছি, তা অবিশ্বাস্য। হড়পা বানের সতর্কতা কিন্তু আগেই জারি করা হয়েছিল। আমার কাছেও মেসেজ এসেছিল। কিন্তু এত বেশি বৃষ্টি হয়ে যে পরিস্থিতি এমন হয়ে যাবে, বুঝতে পারেনি কেউই। এখানকার বাসিন্দারা নন, পুলিশ-প্রশাসনও নয়।
সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এখানকার ভূগর্ভস্থ রেল পরিষেবা। রেললাইনে জল-কাদা ঢুকে ট্রেন বন্ধ। এখানে প্রচুর মানুষ সাবওয়ে দিয়ে যাতায়াত করেন। ওই বৃষ্টির রাতে তাঁরা খুবই বিপদে পড়েছিলেন। আসলে এখানে ভূগর্ভস্থ পথগুলির মধ্যে অনেকগুলি তো দেড়শো বছরের বেশি পুরনো। প্রবল বৃষ্টিতে জলের চাপ বেড়ে যাওয়ায় পাইপলাইন ফেটে যায়। তখন সাবওয়ের ভিতরে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ১২ ঘণ্টার বেশি আটকে থাকতে হয়। বদ্ধ জায়গায় ঠাসা মানুষ, কোনও বায়ুচলাচলের রাস্তা নেই। তার উপরে কোভিড সংক্রমণের ভয় তো আছেই। শুনলাম, যারা সাবওয়ে পরিচালনা করে, সেই ‘মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্টেশন অথরিটি’র লোক এসে অনেক বার দেখে গেলেও ১২ ঘণ্টার আগে কাউকে উদ্ধার করা যায়নি।
বুধবার বিকেল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়। তার আগেই লুইজ়িয়ানার উপকূলে আছড়ে পড়েছিল ঝড়। রাতভর বৃষ্টিতে ডুবে যায় পাঁচটি প্রদেশ। এই কয়েক দিনে নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সির মতো প্রদেশগুলির এই হাল দেখে বুঝলাম, আমাদের এখানকার নিষ্কাশন ব্যবস্থা এত বৃষ্টির সঙ্গে যুঝতে প্রস্তুত নয়। নিউ ইয়র্কে এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাস্তায় ৩ ইঞ্চি জল জমে যায়! ডুবে যায় পথচলতি গাড়ি। বৃষ্টির জলে গাড়ি ভাসছে, এ দৃশ্য দিল্লি বা কলকাতায় দেখা গেলেও অতলান্তিকের পারে এই শহরে বিশেষ দেখা যায় না। এ বার তা-ও দেখলাম!
নিউ ইয়র্কে প্রচুর দরিদ্র অভিবাসী ও শরণার্থী থাকেন। কুইন্স বা ব্রুকলিনের মতো অঞ্চলে অনেকেই থাকেন কোনও না কোনও বাড়ির বেসমেন্টে। বৃহস্পতিবার রাতের বৃষ্টির পরে যে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই বেসমেন্টে থাকতেন। হড়পা বানে হঠাৎ ঘরে জল ঢোকায় ভিতরে আটকে পড়ে মারা গিয়েছেন তাঁরা। শহরের কেন্দ্রস্থল, ম্যানহাটনেও এক এক জায়গার পরিস্থিতি এক এক রকম। আমি যেখানে থাকি, সেখানে সব প্রায় স্বাভাবিক। কিন্তু আমার গবেষণাগারে এক জন কাজ করেন, যিনি বেসমেন্টে থাকেন। তাঁর বাড়িতেও জল ঢুকেছিল, দিন দুয়েক পরে সেই জল বার করা হয়। এই ঝড়ের পরে হাসপাতালগুলোর অবস্থা নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে। ইডায় সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত লুইজ়িয়ানার কোভিড-পরিস্থিতিও খুব খারাপ। জল ঢুকে যাওয়ায় কয়েকটি হাসপাতালে কিছু ক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ ছিল না।
খবরে দেখছি, নিউ জার্সিতে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অন্তত ২৫ জন। শুনছি হড়পা বানের মধ্যে গাড়ি আটকে মারা গিয়েছেন অনেকে। ঝড়ের পরে সেখানে বেশ কিছু বাড়িতে আগুনও লাগে। অনেক জায়গায় এখনও বিদ্যুৎ নেই, ইন্টারনেট নেই। ২০১২ সালে হারিকেন স্যান্ডির পরে হাজার হাজার ডলার খরচ করে নিউ ইয়র্ক ও নিউ জার্সিকে বন্যা থেকে সুরক্ষিত রাখার মতো পরিকাঠামো তৈরি হয়। কিন্তু বেশির ভাগই হয়েছে সমু্দ্রের জল ঢোকা আটকাতে। বৃষ্টি থেকে বাঁচার কোনও রাস্তা তৈরি হয়নি।
স্যান্ডির সময়ে কিন্তু আরও মারাত্মক বিপর্যয় হয়েছিল। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির কিছু ক্যাম্পাসে নীচের তলাগুলি জলের তলায় চলে যায়। ফলে গবেষণার কাজ অনেক দিন বন্ধ ছিল। আসলে, স্যান্ডির সময়ে মানুষ অনেক বেশি সতর্ক ছিলেন। এই বিপর্যয়ের মূলে বিশ্ব উষ্ণায়ন। এবং যা বুঝছি, এটাই শেষ নয়। ভবিষ্যতেও এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদের তছনছ করে দিতে পারে। ইডা সেই আশঙ্কাই বাড়িয়ে দিয়ে গেল।
লেখক
ওয়াইল কর্নেল মেডিসিনের বিজ্ঞানী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy