জয়ের আনন্দ। সোমবার স্বরূপনগরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
বনগাঁর আড়সিংড়ির গ্রামে এক কর্মীর বাড়িতে সভা করতে গিয়েছিলেন সিপিএম প্রার্থী দেবেশ দাস। গিয়ে দেখলেন, সব সুনসান। কেউ কোত্থাও নেই। চাটাই বিছিয়ে আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরেও দু’জনের বেশি লোক জড়ো করা গেল না। অগত্যা বেজার মুখে ওই কর্মীর বাড়ি থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে ফিরে এলেন দেবেশবাবু। ঘনিষ্ঠ মহলে যিনি পরে প্রচার নিয়ে হতাশার কথা গোপনও রাখবেন না।
সিপিএমের পায়ের তলার জমি সরতে শুরু করেছিল যবে থেকে, তারপর আর সেই জমি ফিরে পাওয়ার কোনও লক্ষণই নেই। বনগাঁর ভোটে আশা করা গিয়েছিল, তুলনায় ভাল ফল করবে বামেরা। কিন্তু ফলাফলের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও এ বার প্রচুর ভোট কমেছে সিপিএমের। গত লোকসভা ভোটে বামেরা পেয়েছিল ৩১.৭৬ শতাংশ ভোট। এ বার তা কমে হয়েছে ২৬.৫৪ শতাংশ। এই লোকসান কী ভাবে পূরণ করা সম্ভব, তা ভাবতে নিশ্চয়ই ফের চুলচেরা বিশ্লেষণে বসবেন দলের পাকা মাথার নেতারা। কিন্তু দলের হাল ফেরাতে কী করণীয়, তা হয় এ বারও খুঁজেপেতে বের করা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেই।
গত বার বনগাঁ লোকসভার অন্তর্গত সাতটি বিধানসভার মধ্যে অন্তত স্বরূপনগর কিছুটা অক্সিজেন জুগিয়েছিল অস্তিত্ব সংকটে ভোগা সিপিএমকে। ২০১৪ সালে স্বরূপনগরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ভোটের লিড ছিল তাদের। এ বার সেই ঘাটতি পুষিয়ে তৃণমূল স্বরূপনগরে এগিয়ে গিয়েছে ২৪,৮২৯ ভোটের ব্যবধানে।
কিন্তু বনগাঁ লোকসভায় এই হাল কেন বামেদের?
গত পঞ্চায়েত ভোটে স্বরূপনগর ব্লকের ১০টি পঞ্চায়েতের সব ক’টিতেই জিতেছিল বামেরা। কিন্তু কালক্রমে সব ক’টিই হাতছাড়া হয়েছে তাদের। ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। এলাকায় সিপিএমের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, বিরোধী শক্তি হিসাবে সিপিএম যে শাসক দলের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস জোগাতে পারবে না, তা এক রকম ধরেই নিয়েছেন একদা বামপন্থী মানুষও। ফলে তৃণমূলকে টক্কর দিতে শক্তিশালী বিকল্পের খোঁজে বিজেপির হাত ধরতে চেয়েছেন তাঁরা। সিপিএমের বনগাঁ-বাগদা জোনাল কমিটির সম্পাদক পঙ্কজ ঘোষের মতে, নিরাপত্তার প্রশ্নে বামেদের ভোট গিয়েছে বিজেপির ঘরে। তা ছাড়া, পঞ্চায়েত বা পুরসভার বেশির ভাগগুলিতে এখন ক্ষমতায় তৃণমূল। কিন্তু তৃণমূলের উপরেও যাঁরা বীতশ্রদ্ধ, তাঁরা বেছে নিয়েছেন বিজেপিকেই।”
স্বরূপনগরের মানুষ অবশ্য ভরসা রেখেছেন তৃণমূলের উপরেই। এখানে ৭৫,৯২৬টি ভোট পেয়েছে তৃণমূল। অন্য দিকে, সিপিএম ২০১৪ সালে পেয়েছিল ৭০,১০২টি ভোট। এ বার তারা পেয়েছে ৫০,৯৮৭টি ভোট। কংগ্রেসের অনেকটা গুরুত্ব এক সময়ে ছিল স্বরূপনগরে। কিন্তু এ বার তারাও ধুয়ে মুছে সাফ। গত বার প্রার্থী ২৬,১২০টি ভোট পেলেও এ বার কুন্তল মণ্ডল স্বরূপনগর থেকে পেয়েছেন মাত্র ৭,৫০৮টি ভোট। যার পিছনে কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বড় কারণ বলেও মনে করছেন দলেরই একটি অংশ। সোমেন মিত্রের সভায় দেখা যায়নি বসিরহাটের কংগ্রেস নেতা অসিত মজুমদারকে। দলের এমন দুর্দিনেও কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দেখে এমনকী বিস্মিত অন্য রাজনৈতিক দলগুলিও।
বিজেপির ভোট বাড়লেও স্বরূপনগরে তারা দ্বিতীয় স্থানে। গত বার লোকসভা ভোটে স্বরূপনগরে বিজেপি পেয়েছিল ২৬,১২০টি ভোট। এ বার তা বেড়ে হয়েছে ৩৫,২৯৭।
উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের নিয়ে বিজেপির প্রচার ভাল ভাবে নেননি স্বরূপনগরের মানুষ। বিশেষ করে যাঁরা দীর্ঘ বছর ধরে রেশনকার্ড, ভোটার পরিচয়পত্র নিয়ে বাস করছেন, তাঁদের শরণার্থী বলে নতুন করে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় বিজেপির উপরে চটেছেন বহু মানুষ।
স্বরূপনগরে তৃণমূলের জয়ের অন্যতম কারিগর নারায়ণ গোস্বামী, রমেন সর্দাররা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সততা এবং উন্নয়নমূলক কাজের কাছে বিজেপি-সিপিএমের কুৎসামূলক প্রচার ধোপে টেঁকেনি।”
উদ্বাস্তু নিয়ে প্রচারে এই কেন্দ্রে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি সিপিএমও। বারাসতে বিশাল ভিড় জমিয়ে উদ্বাস্তুদের অধিকার রক্ষায় সভা করবেন বলে জানিয়েছিলেন দলের জেলা সম্পাদক গৌতম দেব। কিন্তু সেই সভা কার্যত ফ্লপ করেছে। ভোটের মুখে সভায় ভিড় জমাতে না পেরে দলের নেতা-কর্মীদের মনোবল আরও তলানিতে গিয়ে পৌঁছয়।
এর কিছু দিন বাদে বনগাঁর এক সভায় এসে গৌতম দেব তরুণ মুখ দেখতে না পেয়ে কটাক্ষ করে বলেন, “দলটা কি বৃদ্ধাশ্রম হয়ে যাবে?” নতুন কর্মী-সমর্থক উঠে না আসায় সাংগঠনিক দুর্বলতাও ভুগিয়েছে সিপিএমকে।
সারদা-কাণ্ডে তৃণমূলকে বিঁধে প্রচারও বিশেষষ সুবিধা দিতে পারেনি সিপিএমকে। স্বরূপনগরে বহু মানুষকে বলতে শোনা গিয়েছে, “টাকা তো তৃণমূলের নেতারা হাতে করে নিয়ে যাননি। তাঁদের শুধু দুষলেই হবে? যে এজেন্টরা টাকা নিল, তারা তো বহাল তবিয়তেই আছে। তা ছাড়া, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য কমিশন গড়েছিলেন। এখন সে সব বন্ধ।” এই মানুষজনের বক্তব্য, “সিবিআই করে হয় তো প্রকৃত অপরাধী পর্যন্ত পৌঁছনো যাবে। কিন্তু তাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের টাকা কি ফিরবে?”
স্বরূপনগরের ক্ষেত্রে আরও একটি কারণ বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গত দিন পনেরো ধরে পাচার একেবারেই বন্ধ। পাচার নিয়ে সীমান্তের কিছু মানুষ যতই আপত্তি জানান না কেন, এক শ্রেণির মানুষের তাতে রুটিরুজি বন্ধ হওয়ার জোগাড়। বিজেপি ক্ষমতায় এলে পাচার পুরোপুরি বন্ধ হতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা। এ দিকে, সিপিএমকে ভোট দিয়ে জেতানোর তেমন কোনও সম্ভাবনাও দেখেননি তাঁরা। এই অংশটিও ভোট দিয়েছেন তৃণমূলকেই।
প্রচারেও এ বার তেমন জোর দেখা যায়নি সিপিএমের। দেবেশবাবু বলেন, “সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের দিকে গিয়েছে। আমাদের উপরে রাগে যাঁরা এক সময়ে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরা এ বার অনেকেই ভোট দিয়েছেন বিজেপিকে।” মমতা ঠাকুর তাঁর স্বামীর ফলে ‘সহানুভূতি ভোট’ও পেয়েছেন বলে মমনে করেন দেবেশবাবু।
সব মিলিয়ে ভোটের ফল প্রকাশের পরে গৌতম দেবের প্রতিক্রিয়া, “এই ফলাফল খুবই কঠিন। এর থেকে বেরিয়ে আশা সহজ নয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy