চৌমণ্ডলপুরে নিহত শেখ জসিমউদ্দিনের বাড়িতে বিজেপির প্রতিনিধিরা। হাজির দলের রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকারও (ডান দিকে)। তাঁদের সামনেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন জসিমউদ্দিনের মা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
যে গ্রামে বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষে রবিবার উত্তাল হল পাড়ুই, সেই সিরশিট্টাকেই এড়িয়ে গেল বিজেপি প্রতিনিধি দল!
সোমবার বিজেপির রাজ্য নেতারা পাড়ুই থানায় বসে বীরভূমের পুলিশ সুপারের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করলেন। পাড়ুইয়ে শান্তি ফেরাতে পুলিশকে ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিলেন। চৌমণ্ডলপুর গ্রামে গিয়ে নিহত দলীয় কর্মী শেখ জসিমউদ্দিনের পরিবারের সঙ্গে দেখা করলেন। কিন্তু, সিরশিট্টার পথ মাড়ালেন না বিজেপি নেতারা। এই গ্রামেই রবিবার বহিরাগত সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের নিয়ে এসে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল বিজেপির বিরুদ্ধে। বিজেপি নেতারা যাদবপুর গ্রামেও যাননি, যেখানে রবিবার সিরশিট্টার হামলার কিছু আগে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি ভাঙচুর ও লুঠপাটের অভিযোগ ওঠে বিজেপির বিরুদ্ধে।
সব মিলিয়ে ‘পাখির চোখ’ পাড়ুইয়ে হঠাৎই যেন অস্বস্তির ছায়া বিজেপি শিবিরে!
বিজেপি নেতৃত্বেরই একাংশের ব্যাখ্যা, তৃণমূলের যে ‘ভুলের’ জন্য বিজেপিতে যোগ দেওয়ার যেন ঢল নেমেছে বীরভূমে (বিশেষ করে পাড়ুই অঞ্চলে), সেই একই ‘ভুল’ হয়েছে সিরশিট্টায়। “শাসক দলের হামলার প্রতিরোধ করা এক জিনিস। তাতে মানুষের সহানুভূতি পাওয়া যায়। কিন্তু শাসক দলের কর্মী-সমর্থকদের উপরে হামলা চালানোর ঘটনা ভুল বার্তা দিয়েছে,” মন্তব্য দলের এক রাজ্য নেতার। তাঁর মতে, গত ২৪ অক্টোবর চৌমণ্ডলপুর গ্রামে পাড়ুই থানার ওসি-র উপরে হামলায় তাদের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নাম জড়ানোয় বেশ বেকায়দায় ছিল বিজেপি। কিন্তু, লাগোয়া মাখড়া গ্রামে ২৭ অক্টোবর তৃণমূলের ‘সশস্ত্র হামলা’র ঘটনা সেই ক্ষতে প্রলেপই শুধু দেয়নি, নিজেদের সংগঠন মজবুত করার একটা সুযোগ এনে দিয়েছিল বিজেপির সামনে। ওই সংঘর্ষে তৃণমূলের দুই এবং বিজেপির এক জন মারা গেলেও ঘটনা থেকে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক ফায়দা লুটেছিল বিজেপিই। বারবার এলাকায় গিয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে, পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে এবং গ্রেফতার বরণ করে শাসক দলকে ধাক্কা দিতে শুরু করেছিল বিজেপি।
মাখড়া-কাণ্ড খানিকটা ‘অ্যাডভান্টেজ’ দিয়েছিল বিজেপিকে। তার পরপরই ইমাদপুর, যাদবপুর ও সিরশিট্টার ঘটনা তাদের কিছুটা ‘ব্যাকফুটে’ ঠেলে দিয়েছে। ঘটনাচক্রে এ দিনই আবার বর্ধমানের জামুড়িয়ার কুনস্তরিয়ায় বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে ঢুকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূলের দাবি, ওই ঘটনায় দলের পাঁচ কর্মী জখম হন। বিজেপি অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়র সভা সেরে ফেরার পথে ওই কার্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে তাদের পাঁচ কর্মীকে তৃণমূলের লোকেরাই মারধর করে।
একান্ত আলোচনায় বিজেপির কিছু নেতা মেনে নিচ্ছেন, আগ বাড়িয়ে আক্রমণ নয়, বরং শাসক দলের আক্রমণ প্রতিহত করাই যে সেরা পন্থা, সেটা বোঝাতে হবে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের বক্তব্যেও এর ইঙ্গিত মিলেছে। তবে বিজেপি কর্মীরা যে আত্মরক্ষার্থে প্রতিরোধ করবেন, সেটাও স্পষ্ট করে দিয়ে তিনি বলেন, “বোমা-বন্দুক নিয়ে আক্রমণ করলে আমাদের কর্মীরা ঠেকাবে না? দাঁড়িয়ে বুক পেতে দেবে?” তবে কি বিজেপি মারের বদলা মারের রাজনীতিরই পক্ষপাতী? রাহুলবাবুর জবাব, “তা নয়। তবে আত্মরক্ষার্থে প্রতিরোধ তো করতেই হবে।”
এ দিন দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ বিজেপির ৫ প্রতিনিধি প্রথমে যান পাড়ুই থানায়। ওই দলে ছিলেন, দলের তিন রাজ্য সহসভাপতি প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাপস চট্টোপাধ্যায় ও সুভাষ সরকার। আর ছিলেন দলের রাজ্য কমিটির সদস্য আর কে মহান্তি ও দলের সংখ্যালঘু সেলের মোর্চার সভাপতি শাকিল আনসারি। সঙ্গে ছিলেন দলের বীরভূম জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলও। এসপি অলোক রাজোরিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক হয়। পরে সুভাষবাবুরা জানান, পুলিশকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার দাবি জানানো হয়েছে। বেআইনি অস্ত্র-বোমা উদ্ধার করে এলাকায় দ্রুত শান্তি ফেরানোর কথাও বলা হয়েছে। রাহুলবাবুও বলেন, “এসপি আমাদের প্রতিনিধিদের জানিয়েছেন, তিনি সর্বদল বৈঠক ডাকতে চান। পুলিশ-প্রশাসন সর্বদল বৈঠক ডাকলে আমরা নিশ্চয়ই যাব। কারণ আমরা শান্তি ও আইনের শাসন ফেরাতে দায়বদ্ধ।” এ দিন সিউড়ির তৃণমূল বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষও (জেলার রাজনীতিতে অনুব্রত মণ্ডলের বিরোধী হিসেবে পরিচিত) বলেন, “বীরভূমের পুলিশ মেরুদণ্ডহীন। তাই পাড়ুই অগ্নিগর্ভ। দুই দলকেই সংযত করতে নিরপেক্ষ ভূমিকা নিক পুলিশ। না হলে অবস্থা আরও খারাপ হবে।”
থানার বৈঠক সেরে চৌমণ্ডলপুরে নিহত দলীয় কর্মীর বাড়িতে যান বিজেপির প্রতিনিধিরা। নিহতের মা জেবউন্নিসা বিবিকে সান্ত্বনা দেন ও পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। সেখানে মিনিট কুড়ি থেকে সোজা সিউড়ি চলে যান তাঁরা। এড়িয়ে যান সিরশিট্টা গ্রামকে। দলের নেতা সুভাষবাবুর দাবি, “জসিমউদ্দিনের ময়নাতদন্ত নিয়ে সিউড়ি হাসপাতালে একটা জটিলতা দেখা দিয়েছিল। তাই ওখানে যাওয়ার তাড়া ছিল। তা ছাড়া, পুলিশও সিরশিট্টায় না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল।” যদিও বিজেপি সূত্রে জানা যাচ্ছে, সিরশিট্টায় গেলে তৃণমূলের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হবে, খবর পেয়ে সে পথ মাড়ায়নি প্রতিনিধি দল। সোমবার বিজেপির দল এলে তাদের কালো পতাকা দেখাতে তৈরি ছিলেন ওই গ্রামের মহিলাদের একাংশ। হাতের পোস্টারে লেখা ছিল, ‘সাম্প্রদায়িক বিজেপি, গো-ব্যাক। আমরা শান্তি চাই’।
যাদবপুর, সিরশিট্টা ও চৌমণ্ডলপুরের ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। যাদবপুরে তৃণমূলের পক্ষ থেকে ৪৬ জন বিজেপি নেতা-কর্মীর নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। সিরশিট্টায় গুলিতে আহত তৃণমূল সমর্থক হোসেন আলির কাকা ২৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। আর চৌমণ্ডলপুরের নিহত বিজেপি কর্মীর বাবা ২২ জন তৃণমূল নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এফআইআর করেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy