রাধিকা এবং গোপ-নারীদের সঙ্গে কার্তিক পূর্ণিমায় শ্রীকৃষ্ণের নৃত্যগীত উৎসব রাসযাত্রা বলে পরিচিত। প্রাচীন কাল থেকে রাসযাত্রা বৈষ্ণবদের গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। তবে শ্রীচৈতন্যের স্মৃতিবিজড়িত বৈষ্ণবধাম নবদ্বীপের রাস উৎসব কিন্তু ব্যতিক্রমী। প্রায় ২৫০ বছরের বেশি সময় বছর ধরে, নবদ্বীপের পাড়ায় পাড়ায় অসংখ্য শাক্ত দেব-দেবীর পুজো হয় রাস পূর্ণিমায়। সেই তুলনায় রাধাকৃষ্ণ এবং অন্যান্য বৈষ্ণব মূর্তির সংখ্যা সেখানে নেহাতই কম।
কথায় বলে নবদ্বীপের শাক্ত রাস!
শাক্ত-বৈষ্ণব বিরোধ বহু যুগের। ইতিহাস বলে, শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের পরে শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের মানুষদের মধ্যে অসদ্ভাব দেখা দেয়। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, বৈষ্ণব ধর্মের অতিরিক্ত প্রভাব এবং জনপ্রিয়তার কারণে নবদ্বীপের শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে নানা অভিযোগ জানাতে থাকেন। কিছু কাল এমনটা চলতে থাকায় নবদ্বীপের পণ্ডিতদের ডেকে রাজা তাঁদের একটা প্রস্তাব দেন।
কী সেই প্রস্তাব?
কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় বাড়িতে তাঁরা যেন নিজ নিজ ইষ্ট দেব-দেবীর পুজো করেন। উল্লেখ্য, সেই সময় নবদ্বীপের বেশির ভাগ পণ্ডিত বিভিন্ন রাজবাড়ি কিংবা অভিজাত পরিবারে দুর্গা, লক্ষ্মী, কালীপুজো করতে নবদ্বীপের বাইরে যেতেন। পুজো শেষে বাড়ি ফিরতেন তাঁরা। শাক্ত-বৈষ্ণব কাউকে না চটিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হল রাস উৎসব। যে জায়গায় কালীর পুজো হয়, তার পাশেই কৃষ্ণের পুজো যে হতে পারে সেটা প্রচলনের উদ্দেশ্যই ছিল কৃষ্ণচন্দ্রের। গবেষকদের মতে, ১৭৫২ থেকে ১৭৫৭-র মধ্যে প্রচলন হয়েছিল এই শাক্ত রাস উৎসবের।
এই রাস উৎসব নবদ্বীপের মানুষের কাছে দুর্গাপুজোর চেয়েও আকর্ষণীয়। রাসপূর্ণিমার দুপুরে এখানে কালী, দুর্গা এবং অন্যান্য শক্তি মূর্তির পুজোয় আগে শ’য়ে শ’য়ে পাঁঠা বলি দেওয়া হত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পশুবলি এখন কমেছে। তবে একেবারে বন্ধ হয়নি।
এই সব মূর্তির উচ্চতা কম করে ২০-২২ হাত। শিল্পীরা আজও বিভিন্ন মণ্ডপে গিয়েই প্রতিমা নির্মাণ করেন। এখানকার প্রথা অনুসারে লক্ষ্মীপুজোর পর দিন থেকে কাঠামো তৈরি হয়। কালীপুজোর পর দিন মূর্তির খড় বাঁধার কাজ শুরু হয়। এরই মধ্যে কাটোয়া এবং মুর্শিদাবাদের শোলা শিল্পীরা এসে প্রতিমার সাজ তৈরির কাজ শুরু করেন। রাসের প্রতিমাগুলি মণ্ডপেও বসানো থাকে বড় বড় চাকা লাগানো লোহার গাড়ির উপর। কারণ রাসের পরের দিন প্রতিমা-সহ বেরোয় রাসের শোভাযাত্রা।
বড়শ্যামা।
এখানে বেশির ভাগ মণ্ডপ সাধারণ মানের হলেও, রাসের প্রধান আকর্ষণ, বৃহৎ আকারের সুসজ্জিত সাবেক প্রতিমা। প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে ‘শবশিবা’, ‘অলোকনাথ কালী’ যা ‘এলানে কালী’ নামে পরিচিত, তেঘরিপাড়ার তিনটি কালীপ্রতিমা— বড়শ্যামা, মেজশ্যামা, ছোটশ্যামা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বৃহৎ আকারের এই সব প্রতিমা শোলার সাজে সজ্জিত। এ ছাড়াও পুরনো পুজোগুলির মধ্যে ভদ্রকালী, গৌরাঙ্গিনী, বিন্ধ্যবাসিনী, বুড়োকালী, মহিষমর্দিনী উল্লেখযোগ্য।
নবদ্বীপের কেন্দ্রীয় রাস কমিটির সহকারী সম্পাদক তথা বড় শ্যামা পুজো কমিটির সহকারী সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ লক্ষ্মীনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বললেন, “নবদ্বীপের বড় শ্যামার পুজো ১১২৫ বঙ্গাব্দে ভৃগুরাম সিদ্ধান্তবাগীশ শুরু করেছিলেন। আজও তান্ত্রিক পদ্ধতি মেনেই পুজো হয়। আগে ৬০-৭০টি পাঁঠা বলি হলেও বর্তমানে ৩০টির মতো বলি হয়। সকাল ৯টায় পুজো শুরু হলেও তা শেষ হতে হতে রাত ৯টা বেজে যায় অতিরিক্ত ভক্ত সমাগমের জন্য।”
কিছু মূর্তিতে আজও তান্ত্রিক প্রভাব স্পষ্ট। যেমন, ব্যাদরাপাড়ার শবশিবা। দেবীর নীচে মৃত বা অচৈতন্য শিব, তার উপর জীবন্ত শিব। তেমনই রাধাবাজারের রণকালীর মূর্তি। অন্য দিকে কিছু শাক্ত মূর্তিতে রয়েছে বৈষ্ণব প্রভাব। যেমন, চারিচারাপাড়ার ভদ্রকালীর মূর্তিতে মহিষমর্দিনী-সহ লক্ষ্মী-সরস্বতীর নীচে হনুমান, দু’পাশে রাম ও লক্ষ্মণকে দেখা যায়। আবার, রামসীতাপাড়ার কৃষ্ণজননীর মূর্তিতে দেখা যায় দুর্গার কোলে শিশু কৃষ্ণকে। তবে পরবর্তী কালে বহু নতুন পুজো ও মূর্তির প্রচলন হয়েছে। যেমন, অকালবোধন, উমা-মহেশ্বর, ভারতমাতা ইত্যাদি।
তবে নবদ্বীপের শাক্ত রাস কি বৈষ্ণবধর্মের উপর শাক্তধর্মের প্রভাব বিস্তারের জন্যই শুরু হয়েছিল?
চারিচারা পাড়ার ভদ্রকালী।
উত্তরটা জানা গেল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের উত্তরপুরুষ সৌমীশচন্দ্র রায়ের কাছে। তিনি বললেন, “মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র শাক্ত হলেও বৈষ্ণববিরোধী ছিলেন না। তার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ রাজবাড়ির বারো দোলের মেলা। এ ছাড়া সারা বছর ধরে রাজবাড়িতে হয় নানা বৈষ্ণব পার্বণ। আসল কথাটা হল, সেই সময় শাক্ত-বৈষ্ণব যে বিরোধ ছিল, কৃষ্ণচন্দ্র একই জায়গায় শ্যাম ও শ্যামার পুজোর মাধ্যমে বিরোধটা মেটাতে চেয়েছিলেন। তারই ফলস্বরূপ প্রচলিত হয় নবদ্বীপের রাস।”
রাসের পরের দিনের আকর্ষণ এই সব বড় বড় প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রা, যা নবদ্বীপের বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমা করে পোড়ামাতলায় পৌঁছয়। কিছু প্রতিমা সে দিন বিসর্জন হলেও বেশির ভাগ প্রতিমা মণ্ডপে ফিরে গিয়ে পরের দিন বিসর্জন হয়।
শোনা যায়, রাস উৎসব প্রচলনের পরে কৃষ্ণচন্দ্র প্রতি বছর রাস পূর্ণিমার পরের দিন পোড়ামাতলায় উপস্থিত থেকে প্রতিমা এবং পুজোর শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করতেন। এমনকী পুরস্কৃতও করতেন। শুধু তাই নয় শ্রেষ্ঠ ঢাকিদেরও পুরস্কৃত করা হত। আজও কিছু প্রাচীন পুজোর সংকল্প হয়ে থাকে কৃষ্ণনগর রাজ পরিবারের সদস্যদের নামে।
স্থানীয় বাসিন্দা দেবমাল্য ভট্টাচার্য জানালেন, সময়ের সঙ্গে বেড়েছে পুজোর সংখ্যা। এসেছে পরিবর্তনও। সাবেক পুজোর পাশাপাশি, গত কয়েক বছরে নবদ্বীপের রাসে প্রবেশ করেছে থিম। এ ছাড়াও কিছু পুজোয় নজর কাড়ছে প্যান্ডেলও। সব মিলিয়ে গত বছর প্রায় ৫৫০টি পুজো হয়েছে রাসে।
আবহমান কালের স্রোতে নবদ্বীপের রাস আজ শাক্ত-বৈষ্ণবের মিলন উৎসব।
ছবি সুদীপ ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy