বাস্তবকে মোকাবিলার তাগিদে শেষমেশ সুরা-আসক্তি নিয়ে ছুৎমার্গ ছাড়ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। রাজস্ব বাড়াতে হলে দেশি মদের বৈধ ব্যবসা বাড়ানো যে একান্ত জরুরি, সরকারের মাথারা তা উপলব্ধি করেছেন। এ-ও মানছেন, আইনসম্মত পথে ‘দিশি’ যত সহজলভ্য হবে, চোলাইয়ের দাপটও কমবে। ঠেকানো যাবে বিষ-মদে প্রাণহানির ঘটনা, সাম্প্রতিক অতীতে মগরাহাট-কাণ্ড যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
বাম পূর্বসুরিদের মতোই বেশি সংখ্যায় মদের দোকানের লাইসেন্স দেওয়ায় মমতার ঘোরতর অনীহা ছিল। বস্তুত ক্ষমতায় আসার পরের তিন বছরে তাঁর সরকার গ্রামাঞ্চলে দেশি মদের দোকানের কোনও লাইসেন্স দেয়নি। লাইসেন্স অবশ্য এখনও দিচ্ছে না। তবে গ্রামে-গঞ্জে-মফস্সলে খাবারের দোকানে দেশি মদ রাখা ও বসে খাওয়ার ঢালাও অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আবগারি দফতর, যা কিনা অদূর ভবিষ্যতে লাইসেন্সপ্রাপ্তির পথ প্রশস্ত করবে।
এবং সেই মতো গত ক’মাসে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে ৬৬টি ধাবা ও খাবারের দোকান দেশি মদ রাখার অনুমতি পেয়েছে। সরকারি-সূত্রের খবর: মার্চ মাসের মধ্যে আরও অন্তত ২০টি দোকানকে এই অনুমতি দেওয়া হবে। ছ’মাস মদ বিক্রির পরে তাদের পাকাপাকি লাইসেন্স দেওয়া হবে। লাইসেন্সদানের পদ্ধতি হবে আগের চেয়ে সরল। অনলাইন আবেদনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। “বেকার ছেলে-মেয়েরা খাবারের দোকানে দেশি মদ রাখতে চাইলে অনুমতি পাবেন। এখন এটাই সরকারের নীতি।” বলছেন এক আবগারি-কর্তা।
পাশাপাশি ‘দিশি’র বিপণনে ‘বিলিতি’র বিপণিকেও কাজে লাগানো হচ্ছে। রাজ্য জুড়ে ৬৮০টি বিলিতি মদের দোকানে দেশি মদ বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। একই ভাবে ১২৭০টি দেশি মদের দোকানে বিলিতিও বেচা যাবে।
মদ নিয়ে জড়তা কাটিয়ে সরকারের এই যে পদক্ষেপ, তাকে বাস্তবোচিত হিসেবেই দেখছেন রাজ্য প্রশাসনের একাংশ। এই মহলের মতে, টানাটানির সংসার সামলাতে মুখ্যমন্ত্রী খানিকটা বাধ্য হয়েই অবস্থান বদলেছেন, যাতে আখেরে কোষাগার অক্সিজেন পাবে।
অর্থ দফতরের তথ্য বলছে, গত অর্থবর্ষে (২০১৩-১৪) রাজ্য আবগারি দফতরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩২০০ কোটি টাকা। বছর শেষে তা অধরাই থেকে যায়। চলতি অর্থবর্ষে (২০১৪-১৫) লক্ষ্যমাত্রা প্রথমে ধার্য হয়েছিল ৩৮০০ কোটি, পরে তা ৩৬০০ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়।
তা সত্ত্বেও লক্ষ্য অর্জন যে সহজ হবে না, কর্তারা ইতিমধ্যে তা বুঝে গিয়েছেন। কারণ, জানুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের অঙ্ক ৩ হাজার কোটিও ছোঁয়নি। এর মধ্যে দেশি মদ থেকে আয়ের পরিমাণ মোটামুটি হাজার কোটি। গত বারের তুলনায় দেশি মদ বাবদ রাজস্ব বেশ কিছুটা বেড়েছে বলে অর্থ দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন।
এমতাবস্থায় রাজস্বের স্রোতে জোয়ার আনতে দেশি মদ সরকারের বড় ভরসা। অর্থ দফতরের এক কর্তার কথায়, “রাজস্ববৃদ্ধি ও চোলাই মদের সঙ্গে টক্কর দিতে শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রাম-মফস্সলেও বেশি সংখ্যায় খাবারের দোকানে দেশি মদ বিক্রির লাইসেন্স দিতে সরকার উদ্যোগী হয়েছে।” তিনি জানান, গ্রামাঞ্চলে খাবারের দোকানে মদ বিক্রির লাইসেন্স পেতে মাসে পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। পুর এলাকা ও কর্পোরেশন এলাকায় লাইসেন্স ফি বেড়ে হচ্ছে যথাক্রমে ১০ হাজার ও ২০ হাজার টাকা।
তিন বছর আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটে বিষাক্ত চোলাই মদ খেয়ে ১৯২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তার পরে রাজ্য সরকার জেলায় জেলায় চোলাই-বিরোধী অভিযানে নামে। কিন্তু প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য ছিল, শুধু চোলাইয়ের ঠেক ভাঙলেই হবে না। একই সঙ্গে দেশি মদের বিক্রি বাড়াতে হবে। ওঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন, আইনসম্মত ব্যবস্থায় দেশি মদ হাতের কাছে না-পেলে প্রচুর মানুষ অবৈধ চোলাইয়ের দিকে ঝুঁকবেন। সেই চাহিদা পূরণ করতে গজিয়ে উঠবে নিত্য-নতুন ঠেক। হামেশাই মগরাহাটের মতো ঘটনা ঘটবে, যার জের সামলাতে পরিবারপিছু দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ গুণতে হবে সরকারকে। “এ এক বিষাক্ত, অন্তহীন আবর্ত। একে শিকড়শুদ্ধু উপরে ফেলতে হলে একেবারে গোড়ায় আঘাত হানতে হবে। শুধু কয়েকটা চোলাইয়ের ঘাঁটি ভেঙে কিছু হবে না।” পর্যবেক্ষণ এক অভিজ্ঞ আমলার।
কোষাগারে আয় বাড়ানোর স্বার্থে মমতা সরকারকে দেরিতে হলেও এখন সেই পথেই হাঁটতে হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy