টাইগার হিলে মুখ্যমন্ত্রী। ফাইল চিত্র
দক্ষিণে আগেই ঘোষণা করেছেন। এ বার উত্তরেও পরিবেশপ্রেমীদের আশঙ্কা বাড়িয়ে তাঁর পর্যটন পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সুন্দরবনের পরে মুখ্যমন্ত্রীর ‘পর্যটন লেন্স’-এ টাইগার হিল। ২১ জানুয়ারি দুপুরে দার্জিলিঙের ডালিতে জেলা পুলিশের একটি অনুষ্ঠান সেরে মুখ্যমন্ত্রী চলে যান টাইগার হিলে। সেখানেই তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানান, টাইগার হিলকে কেন্দ্র করে পর্যটনের নানা পরিকল্পনা রয়েছে। ভিউ পয়েন্ট ও রেস্তোরাঁর পাশাপাশি রাত্রিবাসের জন্য টাইগার হিলে কটেজ তৈরির কথাও ভাবা হচ্ছে বলে তিনি জানান। শনিবার উত্তরবঙ্গ সফরের শেষ দিন শিলিগুড়িতেও সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “টাইগার হিলকে ঘিরে পর্যটন প্রসারের নানা ভাবনা রয়েছে সরকারের।”
মুখ্যমন্ত্রীর এই কটেজ তৈরির ভাবনায় প্রমাদ গুনছে পাহাড়ের পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ও ট্যুর অপারেটর সংগঠনের একাংশ। গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জিটিএ-র কর্তাব্যক্তিদের একাংশের মনেও আশঙ্কার মেঘ জমেছে। নিরিবিলি টাইগার হিলে যে আকর্শনে ছুটে যান পর্যটকরা, মুখ্যমন্ত্রীর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তা হারিয়ে যাবে বলেই মনে করছেন পরিবেশপ্রেমীরা। তাঁদের যুক্তি, বছরের পর বছর দার্জিলিং সফররত লোকজনের কাছে অমোঘ আকর্ষণ হিসাবেই থেকেছে টাইগার হিল। নিরিবিলিতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখা অথবা নির্জনে কিছুটা সময় কাটিয়ে যেতেই পর্যটকেরা টাইগার হিলে আসেন। পরিবেশপ্রেমীদের আশঙ্কা, সরকারি কটেজ তৈরি হলেই এলাকায় একের পর এক বেসরকারি রিসর্টও তৈরি হবে। পর্যটকদের চাহিদা মেটাতে গজিয়ে উঠবে দোকান। কোলাহলময় টাইগার হিল তখন আদৌও পর্যটকদের টানবে কিনা, সে প্রশ্ন যেমন উঠছে, তেমনই ভাবাচ্ছে দূষণের বিষয়টিও।
রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।”
সম্প্রতি শিল্পপতি ও মন্ত্রী-সচিবদের নিয়ে দক্ষিণের গঙ্গাসাগরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, সাগরদ্বীপ-সহ সুন্দরবনের কোণে কোণে পর্যটনের বিকাশ ঘটানো হবে। মুখ্যমন্ত্রী সুন্দরবনে যে ভাবে পর্যটন প্রসারের পরিকল্পনা করেছেন, তাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্টের সমূহ সম্ভাবনা আছে বলে আগেই মত প্রকাশ করেছিলেন পরিবেশবিদদের একাংশ। এ সব নিয়েই কলকাতায় জাতীয় পরিবেশ আদালতের (ন্যশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল) পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চে মামলা করেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। সুন্দরবনে বেআইনি নির্মাণের রমরমা, ম্যানগ্রোভ ধ্বংস, নির্বিচারে মীন ধরা ও কাটাতেলে চালিত মোটরবোটের দাপাদাপিতে সুন্দরবনের পরিবেশ কী ভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ছে, তা আদালতের গোচরে এনেছিলেন তিনি। একই সঙ্গে তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত পর্যটন প্রকল্পের প্রসঙ্গ। আদালত নির্দেশ দেয়, বিধি ভেঙে নির্মাণ করা যাবে না সুন্দরবনে। সেখানে ইতিমধ্যে যত অবৈধ নির্মাণ হয়েছে, সে সবও ভেঙে ফেলতে হবে। যার জেরে মুখ্যমন্ত্রীর সাধের পর্যটন-পরিকল্পনার ভবিষ্যৎও প্রশ্নের মুখে পড়েছে বলে প্রশাসনের একাংশই মনে করছে।
টাইগার হিল নিয়েও মমতার ঘোষণায় নানা মহলে আশঙ্কা ছড়িয়েছে। বর্তমানে টাইগার হিলে নির্মাণ বলতে রয়েছে সূর্যোদয় দেখার একটি দোতলা নজর মিনার। এলাকার শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে, এই আশঙ্কাতেই এত দিন নজর মিনার ছাড়া ওই এলাকায় পর্যটকদের বসার জায়গাও তৈরি করেনি জিটিএ। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন জিটিএ-এর পর্যটন বিভাগের সদস্য দাওয়া লেপচা। তাঁর আশঙ্কা, “টাইগার হিলে সরকারি কটেজ তৈরি হলেই, ব্যবসা টানতে বেসরকারি সংস্থাগুলিও ঝাঁপিয়ে পড়বে। তখন কাউকে নিষেধ করা যাবে না। নিরিবিলি পরিবেশের বদলে ওই জায়গা হয়ে উঠবে হট্টমেলা। তখন পর্যটকেরাই কিন্তু টাইগার হিল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন।” তিনি জানিয়েছেন, পর্যটকদের সুবিধের জন্য টাইগার হিলে একটি ছিমছাম ‘ভিউ পয়েন্ট’ তৈরি করা যেতে পারে।
পরিবেশের প্রশ্ন তুলেছে ‘ফেডারেশন অফ সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন’। সংগঠনের সম্পাদক ভরত প্রকাশ রাই বলেন, “টাইগার হিল এলাকার পরিবেশ অত্যন্ত সংবেদনশীল। সেখানে কটেজ তৈরি হলেই শুরু হবে দূষণ। তার ছাপ পড়বে পরিবেশে।” দূষণ থেকে টাইগার হিলকে রক্ষা করতে তাঁরা পদক্ষেপ করার কথা ভাবছেন বলেও তিনি জানিয়েছেন।
দার্জিলিঙের পর্যটন এজেন্সিগুলির সংগঠনের সভাপতি প্রদীপ লামার কথায়, “দার্জিলিং শহর থেকে টাইগার হিল খুব একটা দূরে নয়। পর্যটকেরা সেখানে গিয়ে কিছু সময়ের মধ্যেই ফিরে আসতে পারেন। তাই সেখানে কটেজ তৈরি করার কোনও প্রয়োজন নেই বলে আমার মনে হয়। উল্টে কটেজ তৈরি হলে পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy