নাম দিয়ে যায় চেনা।
সেই কারণেই বাবা-মায়ের মদনগোপাল মিত্র জননেতা হয়ে বনে যান মদন মিত্র।
কিন্তু আবার সে এসেছে ফিরিয়া! হারিয়ে যাওয়া মদনগোপাল সম্প্রতি হঠাৎ ভেসে উঠেছেন সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতে। শনিবার ভিড়ে ঠাসা আলিপুর আদালতকক্ষে আইনজীবী অশোক মুখোপাধ্যায় উঠে দাঁড়িয়ে যেই বলেছেন, “আমি মন্ত্রী মদনগোপাল মিত্রের হয়ে সওয়াল করছি,” অমনি সবাই নড়েচড়ে বসেছেন! মন্ত্রীর তাবড় ঘনিষ্ঠরাও মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন। এক জন তো ফিসফিস করে পাশে বসা এক আইনজীবীকে বলেই ফেললেন, “মদনদার নামে একটা গোপাল ছিল, তা তো জানতামই না।”
শুধু আইনজীবী কেন, মদনবাবুর দলেও অনেকেই জানতেন না, নেতা হওয়ার আগে ‘মদনদা’ কোনও কালে মদনগোপালও ছিলেন। জানা গেল, শনিবার আদালতের কাগজ দেখার পরেই। এফআইআর থেকে শুরু করে আদালতের যাবতীয় কাগজপত্রে রয়েছেন, মদনগোপালই। মদন মিত্রের সঙ্গে প্রায় তিরিশ বছরেরও বেশি সম্পর্ক, এমন এক নেতার কথায়, “সত্যি কোনও দিন শুনিনি, ওর নাম মদনগোপাল মিত্র। ও তো মন্ত্রী হওয়ার সময়েও মদন মিত্র হিসেবেই শপথ নিয়েছে। মদনগোপাল হলে মদন মিত্র হিসেবে শপথ নিল কী করে?”
কারণ একটাই। পরিবহণমন্ত্রীর ভোটার কার্ডে নাম মদন মিত্রই। মন্ত্রীর পারিবারিক ঘনিষ্ঠেরা জানাচ্ছেন, “ওঁর প্যান কার্ড থেকে সব কিছুতেই মদনগোপাল মিত্র রয়েছে। কিন্তু ভোটে লড়ার আগে এফিডেফিট করে নিজেই নামটা মদন মিত্র করে নিয়েছিলেন।” পরিবার সূত্রে জানানো হচ্ছে, এর পিছনে অন্য কোনও কারণ নেই। মদন মিত্র নামটিই মানুষের কাছে বেশি পরিচিত। নামে কী আসে যায় কথাটা আর যাই হোক, রাজনীতির ময়দানে খাটে না। তাই মাঝখানের ‘গোপাল’টি সযত্নে বাদ দিয়েছেন মন্ত্রীমশাই।
এমন উদাহরণ অবশ্য আরও আছে। জ্যোতি বসু যে কোনও কালে জ্যোতিকিরণ বসু ছিলেন, তা তাবড় বাঙালি বিলকুল ভুলে মেরে দিয়েছে। মদন মিত্রের মতোই নামের মধ্যপদ লোপ পেয়েছে তাঁর বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা রবীন দেবেরও। মদনগোপাল নিয়ে মন্তব্য না করলেও রবীনবাবু জানালেন, তাঁর নাম আদতে রবীন্দ্রচন্দ্র দেব। ভোটার কার্ডে অবশ্য রয়েছে, রবীন দেব-ই। আর পাসপোর্টে রবীন্দ্রচন্দ্র ওরফে রবীন দেব। কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের নামেও একটি ‘ময়’ ছিল। কান্তিভূষণ কিন্তু কান্তি নামেই নেতা-কান্তি হয়েছেন।
আবার বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের নামের সঙ্গে যাদব ছিল না। তাঁর নাম আদতে লালু প্রসাদ। কিন্তু যাদব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হওয়ার কারণে তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে লালুপ্রসাদ যাদব। যাদবকুলের প্রতিনিধি বোঝাতে তিনি নিজেও নিজেকে লালুপ্রসাদ যাদবই বলেন। আবার বিহারের এই জাতপাতের রাজনৈতিক সমীকরণের কারণেই অনেক নেতা কোনও পদবীই ব্যবহার করেন না। নীতীশ কুমার তার বড় উদাহরণ।
নামের এই পরিবর্তন কিংবা সংক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনও নিয়ম নেই। পুরোটাই সময়ের দাবি, মনে করছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “যুগের প্রয়োজনে নাম সংক্ষিপ্ত হয়। বয়স্কদের দেখা যায়, বড় বড় নাম। কিন্তু এখন অনেকেই নামে বেশি জবরজং চান না।” শীর্ষেন্দুবাবু জানাচ্ছেন, সে জন্য সমাজে মধ্য-নামও ধীরে ধীরে অবলুপ্তির পথে। ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের নাম আদতে ছিল পবিত্রভূষণ সরকার। কিন্তু তিনি পরে ভূষণটি ছেড়েছেন। বলছেন, বাঙালিদের সংক্ষিপ্ত নামের প্রতি ঝোঁকটা অনেক দিনের। তার উপরে বিদেশে বা ভারতের অন্য জায়গায় মধ্যনাম পৃথক অর্থ বহন করে। কিন্তু বাঙালিদের ক্ষেত্রে মধ্যনাম সাধারণত প্রথম নামের অর্থের সঙ্গে যুক্ত। যেমন, হরিচরণ নামে চরণ আর হরির একটা যোগাযোগ রয়েছে। তাই নাম সংক্ষিপ্ত করতে গিয়ে মধ্যনামও ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে বলে মনে করছেন পবিত্রবাবু।
আর মদনবাবুর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা কী বলছেন? সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম বলছেন, “আগে জানতাম তৃণমূল নেতাদের জন্মদিন নিয়ে নানা ধন্দ রয়েছে। এখন দেখছি, নাম নিয়েও নানা লুকোচুরি। শ্যামাপদ হয়ে যাচ্ছেন শ্যামাপ্রসাদ। মদন হয়ে যাচ্ছেন মদনগোপাল।” আর, বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের কটাক্ষ, “গোপাল অতি সুবোধ বালক। মদনবাবু বুঝেছিলেন, তাঁর সঙ্গে গোপাল নাম যায় না। তাই ত্যাগ করেছেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy