মেয়ের সঙ্গে হালিমা বিবি।
সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে বিক্রি করে দেওয়া হতে পারে এই আশঙ্কায় ‘ডিসচার্জ’ করে দেওয়ার পরেও পুলিশের সাহায্যে সেই শিশুকে বাড়ি থেকে আবার ফিরিয়ে আনল এক সরকারি হাসপাতাল।
টালিগঞ্জের এম আর বাঙুর হাসপাতালে গত ১৫ অক্টোবর শিশুকন্যার জন্ম দেন ক্যানিংয়ের জীবনতলার প্রত্যন্ত গ্রাম মিঞার ভেড়ির হালিমা বিবি। তাঁর একটি চার বছরের কন্যা রয়েছে। দ্বিতীয় বার কন্যাসন্তান জন্মানোয় ক্ষুব্ধ ইদ্রিশ আলি মোল্লা হাসপাতালে ভর্তি স্ত্রী হালিমা এবং সেখানে উপস্থিত আত্মীয়দের সামনেই হুমকি দেন এক দালালের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা পাকা হয়ে গিয়েছে। সদ্যোজাতকে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেবেন।
ওয়ার্ডের আয়াদের থেকে সেই খবর শুনে নড়েচড়ে বসেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ততক্ষণে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দেখিয়ে সদ্যোজাতকে নিয়ে চলে গিয়েছেন ইদ্রিশ। হাসপাতালে হুলস্থূল শুরু হয়। কান্নাকাটি করতে থাকেন শিশুর মা। খবর যায় যাদবপুর থানায়। স্বামী তাঁর মেয়ের ক্ষতি করে দিতে পারেন বলে থানায় লিখিত অভিযোগ করেন হালিমা বিবি।
তার পরেই পুলিশ সঙ্গে নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে করে গ্রামে গিয়ে মাঝ রাতে শিশুটিকে হাসপাতালে ফিরিয়ে আনেন বাঙুরের রোগী সহায়কেরা। মেয়েকে বিক্রির ছকের কথা অস্বীকার করছেন বাবা। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে জীবনতলা থানার পুলিশ। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়, “সরকারি হাসপাতাল থেকে সদ্যোজাতের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি ঘটে। তখন শিশুবিক্রি-চক্র প্রসঙ্গও উঠে আসে। সরকারি হাসপাতালে রোগী ও ডেলিভারির বিপুল চাপে প্রত্যেক রোগীর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়তো সম্ভব হয় না। তা সত্ত্বেও শিশুর ক্ষতি হতে পারে আঁচ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে সক্রিয়তার সঙ্গে শিশুটিকে ফিরিয়ে এনেছেন, তা প্রশংসনীয়।” আপাতত যতদিন প্রয়োজন শিশুটিকে হাসপাতালে রাখার জন্য ‘রোগী কল্যাণ সমিতি’র তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ করেছে স্বাস্থ্য দফতর।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, এক মাস আগে ১৩ সেপ্টেম্বর ৩৫% অগ্নিদগ্ধ হালিমা বিবি বাঙুরে ভর্তি হন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ১৫ অক্টোবর তাঁর কন্যাসন্তান হয়। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে হালিমা বলেন, “স্বামী ড্রাইভার। নেশাগ্রস্ত হয়ে রোজই মারধর করত। পেটে বাচ্চা আসার পর থেকেই বলত, আবার মেয়ে হলে বিক্রি করে দেবে। এক দিন নেশার ঘোরে এমন ধাক্কা মারল যে জ্বলন্ত কুপির উপরে পড়ে পুড়ে গেলাম।” আরও বলতে থাকেন, “দ্বিতীয় বার মেয়ে হওয়ার কথা শুনেই ওয়ার্ডে ঢুকে এসে চিৎকার করে সকলের সামনেই বলল, মেয়েকে বিক্রি করে দেবে। অনেক কান্নাকাটি করলাম কিন্তু ও বলল, বিক্রি করবেই।” হালিমার দিদি অঞ্জুমা বিবির কথায়, “ইদ্রিশ আমাদেরও বলে গিয়েছিল, মেয়েকে বিক্রি করবে। তাতে অনেক টাকা পাবে।”
হাসপাতালের সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে এই খবর যাওয়ার পরেই তিনি ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’ (এসএনসিইউ)-এর চিকিৎসকদের নির্দেশ দেন, ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দেখালেও যেন শিশুটিকে কোনও ভাবেই বাবার হাতে ছাড়া না হয়। যখন মা বাড়ি যাবেন, তখন পাঠানো হবে। এর পরেই গোলমাল বাধে। এসএনসিইউ-এর প্রধান সুদক্ষিণা ভর এই নির্দেশ সম্পর্কে বিভাগের অন্য চিকিৎসকদের জানাতে ভুলে যান।আর ইদ্রিশ বাচ্চা নিয়ে চলে যান। খবর যায় থানায়। বিষয়টি জানানো হয় ডিসি (দক্ষিণ শহরতলি) সন্তোষ পাণ্ডেকে। তিনি দু’জন অফিসারকে হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গে দেন শিশুটিকে নিয়ে আসার জন্য।
শিশুকে কোলে পেয়ে চোখের জলে ভেসে হালিমা বলেন, “সকলের সাহায্যে এ বারের মতো ওকে বাঁচাতে পারলাম। পরে ওর বাবার কুমতি হলে বাঁচাতে পারব কি না, জানি না।” কলকাতা শিশুকল্যাণ কমিটির সদস্য অমিত ভট্টাচার্য ঘটনার খবর পেয়ে বলেন, “মায়ের যদি মনে হয় শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে, তা হলে আমরা শিশুর জন্য হোমের ব্যবস্থা করতে পারি।” আর যাঁর জন্য এত কিছু সেই ইদ্রিশ আলির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নির্লিপ্ত গলায় বলেন, “আবার মেয়ে হয়েছিল বলে রাগে বিক্রির কথা বলেছিলাম। আসলে কোনও দালালের সঙ্গে কথা হয়নি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy