মালখানের বাবা-মা। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।
সকালেই খবর পেয়েছিলেন বড় ছেলে গ্রেফতার হয়েছে। তারপরেই মালখান সিংহের মা সিন্ধু মণ্ডল জনে জনে জিজ্ঞাসা করছিলেন, “আমার ছেলেকে ওরা মেরে দেয়নি তো?” যখন শুনলেন ছেলে সুস্থ অবস্থাতেই পুলিশ হেফাজতে রয়েছে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সিন্দুদেবী জানিয়ে দিলেন, “জেল থেকে ফিরুক। বিয়ে দিয়ে দেব। দেখব, আর যাতে ও কুপথে না যায়।”
তবে মালখান ধরা পড়েছে শুনেও তাঁর পরিবারের কেউই রবিবার আদালতে বা পুলিশের থানায় যাননি। তাঁর জামিনের জন্যও উদ্যোগী হননি তাঁর পরিবারের কেউ। বরং ছেলে আবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে শোনার পরে মালখানের বাবা শচীন মণ্ডল বেরিয়ে পড়লেন চাষের কাজ করতে। মালদহের হবিবপুরের গোটা কাংসা গ্রামেই এ দিন স্বস্তির হাওয়া। গ্রামবাসীদের বক্তব্য, মালখান কেএলও-র জঙ্গি। তাই তাকে ধরতে রাত নেই দিন নেই বারবার পুলিশ গ্রামে আসত। সকলে তটস্থ হয়ে থাকতেন। গ্রামবাসীরা জানান, কাংসা গ্রামের বাসিন্দা বলে পুলিশ তাঁদেরও সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখত, পুলিশ ভাবত কাংসা গ্রামের সবাই মালখান সিংহের লোক। গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, “বাইরে গেলেও গ্রামের নাম শুনলে অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। আজ সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলাম মনে হচ্ছে।” সিন্ধুদেবীও কেঁদে ফেলে বলেন, “পুলিশ হুমকি দিত, ছেলে ধরা না দিলে গুলি করে মারবে। তাই ও গ্রেফতার হয়েছে শুনে প্রথমেই মনে হয়েছিল, গুলি করে মেরে দেয়নি তো?”
পুলিশের মালদহ রেঞ্জের ডিআইজি সত্যজিৎ বন্দোপাধ্যায় বলেন, “এনকাউন্টার করে কাউকে মেরে কখনওই সমস্যার সমাধান করা যায় না। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শ্যাম সিংহের নেতৃত্বে আমাদের যে দলটি মালখান সিংহকে ধরার জন্য আড়াই মাস ধরে কাজ করছিল, তাঁদের কড়া নির্দেশ দেওয়া ছিল, মালখানকে জীবন্ত ধরতে হবে। আমাদের পুলিশ কথা রেখেছে। যে দলটি মালখানকে ধরেছে তাদের পুরস্কৃত করা হবে।”
মালখানকে এই নিয়ে তৃতীয়বার গ্রেফতার করা হল। ২০০৬ সালে ২২ জানুয়ারি ডিওয়াইএফআই নেতা শেখর সিংহকে খুন করা হয়। সেই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ সে বছরই ১৬ ফেফ্রুয়ারি মালখানকে গ্রেফতার করেছিল। পাঁচ বছর পরে ২০১০ সালে জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন মালখান। এরপর ফের ২০১১ সালে পুলিশ অস্ত্র রাখার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে। কিন্তু সেই সময় পুলিশ ৯০ দিনের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে চাজশিট জমা দিতে না পারায় মালখান জামিনে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার কিছু দিন পর থেকেই মালখানের বিরুদ্ধে ফের তোলা আদায়ের অভিযোগ উঠতে থাকে। এরই মধ্যে কেএলও মালখান সিংহকে সাংগঠনিক সম্পাদক ঘোষণা করে। এরপর থেকেই মালখান গা ঢাকা দেন। বছর ঘুরতে চলল, বাড়িতে তাঁর সন্ধান মেলেনি।
পাকুয়াহাট ঢোকার তিন কিলোমিটার আগে মালদহ-বামনগোলা রাজ্য সড়কের ধারের গ্রাম কাংসা। শচীনবাবুরা পাঁচ ভাই। সবাই একই গ্রামে থাকেন। তবে হাঁড়ি আলাদা। শচীনবাবুর ভাগে ১২ বিঘা জমি। কিছু দিন আগে গম, সরিষা জমি থেকে উঠেছে। এখন ১ বিঘা ১০ কাঠা জমিতে পটল ও লাউয়ের চাষ করেছেন। তাঁর চার ছেলে ও এক মেয়ে। দু’মাস আগে পুলিশ তাঁর মেজ ছেলে যাদব মন্ডলকেও কেএলও-র সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করেছিল। এখন তিনি জেলে। মালখানের ছোট বোন সরস্বতী সরকার জানান, এ দিন আদালতে যাননি ঠিকই, তবে পরে একদিন মালখানকে দেখতে যাবেন। তিনি বলেন, “দাদাকে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। অনেকদিন দেখিনি।” সরস্বতীদেবী জানান, মালখানের খোঁজে পুলিশ তাঁর শ্বশুরবাড়িতেও হানা দিয়েছিল। তিনি বলেন, “আমার মোবাইলও কেড়ে নিয়েছিল পুলিশ। এখন দাদা ধরা পড়ে গিয়েছে, আর আমাদের উপর পুলিশের অত্যাচার হবে না। এ কথা ভেবেই মনটা খুব ভাল লাগছে।”
বড় ছেলে ধরা পরার পরই এ দিন সিন্ধুদেবী পুলিশের কাছে আর্জি জানিয়েছেন যে, “মালখানকে তো গ্রেফতার করেছে পুলিশ, এ বার মেজ ছেলে যাদবকে ছেড়ে দিক। ও তো কোনও অপরাধ করেনি।” ডিআইজি সত্যজিৎবাবু অবশ্য বলেন, “মালখানের ভাইকে যে অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হলে এ ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy