অকাল হোলি। উপাচার্য পদ থেকে অভিজিৎ চক্রবর্তীর অপসারণে উচ্ছ্বাস পড়ুয়াদের। ছবি: সুদীপ আচার্য
আসলে তাঁকে চেয়েছিল সরকার। যাদবপুরের ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে শহরের রাজপথও যখন পড়ুয়াদের কলরবে উত্তাল, সেই সময়ে ঝুঁকি নিয়েই তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী উপাচার্য পদে উন্নীত করা হয়েছিল। এক দিন সেই উপাচার্যই বলে বসলেন, পাবলিক নাকি তাঁকে চাইছে! সে দিন থেকেই শুরু এক নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত পর্বের। যার নাটকীয় পরিসমাপ্তি ঘটল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঝটিকা অভিযান এবং উপাচার্যের সরে যাওয়ার ইচ্ছা-ঘোষণায়!
নৈতিক ভাবে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আদৌ কোনও কৃতিত্বের কাজ যে করেননি, তা নিয়ে সংশয় নেই শিক্ষা জগতের বড় অংশেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বশাসিত পরিসরে এ ভাবে সরকার ঢুকে পড়বে কেন, সেই প্রশ্নই এখন সব চেয়ে জোরালো। কিন্তু একই সঙ্গে বিস্মিত শিক্ষা জগৎ এই প্রশ্নও তুলছে, যে উপাচার্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ পাঠিয়েছিল সরকার, যে উপাচার্যের জন্য বিভিন্ন মহলের লাগাতার সমালোচনা উপেক্ষা করেছিল, তাঁকেই পদ থেকে সরাতে উদ্যোগী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বশাসন ভাঙতে গেলেন কেন? সরকারের অভ্যন্তরীণ ময়না তদন্ত বলছে, ‘আমাদেরই লোক’ হয়েও উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী (যদিও তাঁর দাবি, তাঁকে অন্যায্য ভাবে রাজনৈতিক রং লাগিয়ে দেখা হয়েছে) আসলে ‘স্বশাসিত’ হতে চেয়েছিলেন! তার পরিণতি যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে!
যাদবপুরের পড়ুয়ারা আগেই গণভোট করে অভিজিৎবাবুর পদত্যাগের দাবিকে তাদের মতো করে ‘বৈধতা’ দিয়েছিল। রাজ্য সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী অবশ্য সেই দাবির আইনি বৈধতা স্বীকার করেননি। যদিও একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে কলম ধরার দায়ে উপাচার্যের জবাবদিহি তলব করা হয়েছিল রাজভবন থেকে। সরকারি সূত্রের খবর, তার পরেও সতর্ক হননি উপাচার্য। তাঁর পদত্যাগের দাবি যখন প্রতিদিন বাড়ছে, সেই সময়েই অভিজিৎবাবু এক দিন সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করে বসেন, “পাবলিক আমাকে চাইছে!”
উপাচার্যের মন্তব্য শুনে চমকে উঠেছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী! শিক্ষা দফতরের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, এমন অদ্ভুত কথা উপাচার্য বলছেন কেন? তাঁর কাছে জবাব চাইতে গেলে সরকারের মুখের উপরে উপাচার্য বলে দেন, তিনি কী বলবেন, সেটা সম্পূর্ণই তাঁর এক্তিয়ার। সরকার নিশ্চয়ই তাঁর বক্তব্য ঠিক করে দেবে না!
রাজনীতি এবং দলতন্ত্রের গ্রাসে থাকা এ রাজ্যের শিক্ষা ক্ষেত্র প্রত্যাশিত ভাবেই কোনও উপাচার্যকে এমন স্বশাসনের অনুমোদন দেয় না! সে দিন থেকেই অভিজিৎবাবুর মাথার উপর থেকে হাত তুলে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু মমতার। সরকার সুযোগ খুঁজে গিয়েছে, উপাচার্যও সুযোগ দিয়ে গিয়েছেন। প্রেসিডেন্সির এক ছাত্রীর রহস্য-মৃত্যু নিয়ে যাদবপুরের উপাচার্যের মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর নজর এড়ায়নি। যাদবপুরের পড়ুয়ারা অনশনে বসার পরে বিকাশ ভবনে বৈঠক ডেকে উপাচার্যকে সরকারের অসন্তোষ সমঝে দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শেই গোটা বিষয়টি গোচরে আনা হয়েছে রাজ্যপাল ত্রিপাঠীর। তিনিও যাদবপুরের ছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে উপাচার্যকে কড়া বার্তা দিয়েছেন। তবুও উপাচার্য স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেননি। শেষ পর্যন্ত স্বশাসনের চৌকাঠ পেরিয়ে যাদবপুরের ক্যাম্পাসে মুখ্যমন্ত্রীর নাটকীয় অনুপ্রবেশ! শাসক দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “পরিস্থিতিই এক দিন মুখ্যমন্ত্রীকে বাধ্য করেছে হস্তক্ষেপ করতে।” অভিজিৎবাবু অবশ্য শাসকের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্বের পর্ব নিয়ে মুখ খোলেননি।
তথ্যের খাতিরে উল্লেখ্য, অনিল বিশ্বাসের জমানায় যা ছিল কেবলই পর্দার অন্তরালের নিয়ন্ত্রণ, তৃণমূল আমলে আইন সংশোধন করে সেখানেই উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে কী কী কারণ দেখিয়ে উপাচার্যকে অপসারণ করা যায় এবং সরকার সেখানে কী ভূমিকা নিতে পারে! যদিও ‘আইন’ বাঁচাতে মুখ্যমন্ত্রী নিজে কোনও সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে নেননি। রেজিস্ট্রারের মোবাইলে উপাচার্যের এসএমএস আনিয়েছেন এবং সেটা সর্বসমক্ষে পড়ে দিয়েছেন। পরে মঙ্গলবার রাজ্যপালকে ফোন করে সেই বৃত্তান্ত জানিয়ে দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, আইন বাঁচাবেন বলে মুখ্যমন্ত্রী যা করেছেন, তাতে ‘অবৈধ হস্তক্ষেপে’র চেষ্টাই আরও বেআব্রু হয়েছে! বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “যাদবপুরে আর একটা গোল খেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী!” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, “চার মাস পরে কি বোধোদয় হল?”
এমন ‘বোধোদয়’ কি দরকার ছিল? মুখ্যমন্ত্রী কেন গেলেন স্বশাসনের গণ্ডি অতিক্রম করতে? শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, “যখন অচলাবস্থা চলছিল, তখন বলা হচ্ছিল সরকার কেন কিছু করছে না? যখন মুখ্যমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করলেন, তখন বলা হচ্ছে কেন করলেন! একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনের পর দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে, তাতে সরকারের কোনও দায়িত্ব নেই?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy