অরিন্দম চক্রবর্তীর হাতে ১৪২০ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দ। রয়েছেন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার। মঙ্গলবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
সুখের সঙ্গে যশের কি আদতে কোনও সম্পর্ক আছে? সমানুপাতের অঙ্কের মতো, যশ যত বাড়বে, সুখও সেই ভাবে ধাপে ধাপে বেড়ে চলবে? তা হলে কেমব্রিজে ছাত্রাবস্থায় যশস্বী হয়েও কেন সুখী ছিলেন না উইটগেনস্টাইন? যশোশিখরে থেকেও কেনই বা এক দিন হঠাৎ আত্মহত্যা করেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে?
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আনন্দ পুরস্কার অনুষ্ঠানে এই প্রশ্নগুলিই তুলে ধরছিলেন অরিন্দম চক্রবর্তী। ‘ভাতকাপড়ের ভাবনা ও কয়েকটি আটপৌরে দার্শনিক প্রয়াসে’র জন্য তাঁর হাতে নববর্ষের সন্ধ্যাতেই আনন্দ পুরস্কার তুলে দিলেন বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দ। তার পরই দার্শনিক জানালেন তাঁর উপলব্ধি: ‘সুখ কোনও দিনই যশের শর্ত নয়। বরং যশ আমাদের আত্মাভিমান বাড়িয়ে দেয়।’ শুনতে শুনতে মনে পড়ল, যা কিছু আমার নয়, তাকে নিজের ভেবে নেওয়াকেই তো ভারতীয় দর্শনে অভিমান বলে! সে তো স্রেফ অমিতাভ-জয়ার হিট ছবি নয়!
যশ তা হলে কী? টিভি এবং পেজ থ্রিতে নিত্যনৈমিত্তিক ছবি? আজ যারা সচিন বা শাহরুখকে মাথায় তুলে নাচে, আগামী কাল আশাভঙ্গ হলে তারা তো সেই নায়কদেরই গালিগালাজ করে? যশ তো মিডিয়া, জনতা-জনার্দন, অনুরাগীদের বিচার, খামখেয়াল, পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভরশীল। সেখান থেকেই ন্যায়শাস্ত্রকার উদয়নাচার্যের কথা তুলে জানালেন তিনি, সর্বং পরবশং দুঃখম্। যা কিছু অন্যের উপর নির্ভরশীল, তাই দুঃখ। যশও ঠিক তাই।
এখানেই অরিন্দমের রসবোধ। যে রসবোধ সত্যের ইঙ্গিত দেয়, আচমকা নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। কিন্তু কাতুকুতু দিয়ে হাসায় না। প্রারম্ভিক ভাষণে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার সে দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন, ‘প্রচলিত সংস্কার অনুযায়ী রবি ঘোষ বা হিন্দি সিনেমার মেহমুদ রসিক।...কিন্তু শাস্ত্রে বলা হয়েছে নব রসের কথা। সেই নব রসের কোনও একটিতে যিনি পারঙ্গম হয়েছেন, তিনিই রসিক।’ অরিন্দম করুণারসে স্নিগ্ধ বলেই তো আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত বইয়ে প্রশ্ন তোলেন, ‘যারা শুধু আলুপোড়া খেয়ে বাঁচছে ভারতেরই গ্রামগঞ্জে, তাদের কাছে ধনীদের কতখানি ধার রয়ে গেল?’ বৈষম্যে কোনও দিনই হয় না রসের আত্তীকরণ। রসশাস্ত্রকার অভিনবগুপ্তের ঢের আগে ভট্টনায়ক তাই বলেছিলেন, ভয়, ঘৃণা, ক্রোধ, শোক সাধারণীকৃত হলেই রস হয়ে ওঠে। নিঃস্বার্থ নিরহংকার সুষমা সৃষ্টি করতে পারে। বৈষম্যপীড়িত সমাজে অরিন্দম সেই নিঃস্বার্থ সুষমার কথাই মনে করান, ‘সৌন্দর্যের অন্য নাম সুষমা। তার বিপরীত হল বৈষম্য।’
সম্মান অনুষ্ঠানে পাঠ-করা মানপত্রটিও মনে পড়িয়েছে এই সুষমার কথা। স্বপন চক্রবর্তী পাঠ করছিলেন সেই অভিজ্ঞানপত্র: ‘আপনি সমন্বিত করেছেন দার্শনিক অর্ন্তদৃষ্টি ও সামাজিক বিবেক, প্রাতিষ্ঠানিক বিচার ও লোকায়ত প্রজ্ঞা।’ এই সমন্বয়েই তৈরি হয়েছে অরিন্দমের অনন্য দর্শনবিচার।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দ উপনিষদের এই লোক-ব্যবহারের কথাই বলছিলেন। যাজ্ঞ্যবল্কের যখনই গরু দরকার পড়ত, ব্রহ্মবিদ রাজা জনকের সভায় এসে শাস্ত্রবিচার করতেন। তার পর উপহারস্বরূপ গরু নিয়ে চলে যেতেন। ব্রহ্মবিদ হলে কী হয়? মানুষ সুখী হয়, দারা-পুত্র-পরিবার, শিষ্যসন্ততি নিয়ে সুখে বাস করতে পারে। সন্ন্যাস অনেক পরের কথা। উপনিষদের সময় মানুষ সংসারে থেকেই ব্রহ্মজ্ঞান পেত। গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী জানালেন, উপনিষদে দুঃখ শব্দটিই নেই।
অরিন্দম নিজে অবশ্য এ দিন শুধু উপনিষদে আবদ্ধ থাকেননি। উদয়নের ন্যায়শাস্ত্র থেকে জানিয়েছেন, সুখও এক রকমের দুঃখ। কারণ সুখের পরেই দুঃখ আসে। সুখের সমাপ্তি টকে-যাওয়া, একঘেয়ে সুখের বিষয়ে হাহুতাশে। দর্শকের করতালিতে ভরে যেতে যেতে জানালেন তিনি, সুখও আসলে চিনতে না-পারা এক রকমের দুঃখ।
আনন্দ পুরস্কার গ্রহণের পরে বক্তৃতা দিচ্ছেন অরিন্দম চক্রবর্তী। মঞ্চে উপস্থিত স্বপন চক্রবর্তী। —নিজস্ব চিত্র
তাঁর বক্তৃতায় এ দিন থেকে থেকেই উপচে পড়ছিল কৌতুক, ‘‘দক্ষিণ ভারতের গায়ক বালমুরলী কৃষ্ণ সকৌতুক বলেছিলেন, ভূপালি রাগ আজকাল আর গাই না। তাতে সা রে গা মা-র ‘মা নি’ নেই।’’ সুরসিক অরিন্দম এ ভাবেই কখনও সুরের চলনের সঙ্গে অক্লেশে টাকার ইংরেজি মিশিয়ে দিলেন, কখনও যশের দোষ দেখাতে নাম না করে টানলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। যশোদর্শন হলে অভিমান বাড়ে, নিজের খুঁত মানুষ দেখতে চায় না। আর সে দিন থেকেই প্রভু, আমরাও নষ্ট হয়ে যাই। যশ মানে তো নামডাক। অরিন্দম জানালেন, ‘এই ডাক মানে পোস্ট অর্থে চিঠি পাওয়া নয় শুধু। এই ডাক মানে আহ্বান।’ মানপত্রও তাঁর ‘সংশয়ী বিচার ও সরস কৌতুক’-এর কথা উল্লেখ না করে পারেনি।
স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দও বলেছেন এই কৌতুকের কথাই। রামকৃষ্ণের রসবোধের বিভিন্ন ঘটনা জানিয়েছেন তিনি। কখনও বিদ্যাসাগর-রামকৃষ্ণের রসিকতা, কখনও বা ‘যে সয়, সে রয়/ যে না সয়, সে নাশ হয়।’ ভাতকাপড়ের দৈনন্দিনতা থেকেই উঠে আসে দর্শন। নইলে রামকৃষ্ণ কী ভাবেই বা বলবেন, ‘সিদ্ধ হলে নরম হয়।’ রসনারসে বঞ্চিত ছিলেন না বিবেকানন্দও। নইলে মৃত্যুর আগে কেনই বা গঙ্গা থেকে ইলিশ এনে তেলঝোল খাবেন, কেনই বা নিজের হাতে গরম গরম ফুলুরি ভাজবেন!
‘মহাভারতের কথা’ বইয়ে বুদ্ধদেব বসু একদা অনুক্রোশ মানে করেছিলেন করুণা। আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত বইয়ে অরিন্দম সেই সংজ্ঞাকে আরও বিশদ করেছেন, ‘যে নৈতিক ধর্মবোধ শুধু দণ্ডের ভয়ে অথবা যশের আশায় নয়, ঔচিত্যমাত্র নির্ভর শুভাশুভবোধে মানুষকে মানবতা দেয়, তার মূলে থাকে মহাভারতের অনুক্রোশ।’ প্রধান সম্পাদক তাঁর প্রারম্ভিক ভাষণে অরিন্দমের সংস্কৃত, ইংরেজি, বাংলা তিন ভাষাতেই ব্যুৎপত্তির কথা বলছিলেন, ‘দর্শনে তাঁর ব্যুৎপত্তি যতখানি, সংস্কৃতে তার একাংশও কম নয়।’ ভাষাবিচার আর দার্শনিক জ্ঞান থেকেই ন্যায়শাস্ত্রের পাশাপাশি মহাভারত নিয়েও সাম্প্রতিক কালে বহুমাত্রিক ভাবনায় জারিত হয়েছেন অরিন্দম। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর যুগ্ম ভাবে সম্পাদিত, সদ্য-প্রকাশিত ‘মহাভারত নাউ’ বইয়ে ‘এথিক্স অব কনভারসেশন’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন ব্রহ্মবিদ রাজা জনক ও পরিব্রাজিকা সুলভার কথোপকথন। সুলভার সঙ্গে কথা বলার সময় ব্রহ্মবিদ রাজা মুক্ত হতে পারেননি তাঁর অহং থেকে, ‘কে তুমি নারী? কোন বংশে জন্ম? এ ভাবে আমার সঙ্গে মিলনের চেষ্টা করছ কেন, দুশ্চরিত্রা?’ অহং থেকে অহেতুক আক্রমণে গেলে কথোপকথনে আর থাকে না মহাভারতীয় নীতি। সুলভা অহং না রেখেই রাজার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। ফল, ব্রহ্মর্ষির পরাজয়।
মিশেল ফুকো যাকে ‘পারহেসিয়া’ বা সত্যবাদিতার সাহস বলেছিলেন, সেই সাহস কি ছিল মহাভারতের এই কাহিনিতেও? সেই বহুমাত্রিক সাহস থেকেই সুখ আর যশের থেকে আনন্দকে আলাদা করে দিলেন অরিন্দম। তাঁর মতে, আনন্দ সুখদুঃখের ও-পারের জিনিস। তার ডাক শুনতে গেলে ধর্ম-অধর্ম সুখ-দুঃখ দুইই ত্যাগ করতে হবে। এর পর সেই ত্যাগটাকেও ত্যাগ করে একাকী চলে যেতে হবে শূন্যস্থানে। সেখানেই তো চরম আনন্দ...আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি...
পুরস্কারের নামডাক আর যশের সঙ্গে সেই আনন্দের তুলনা হয় নাকি! পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যায় আনন্দ শব্দটিই এক অন্য মাত্রা পেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy