সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারিতে কোন কোন রাঘববোয়াল জড়িত, তাঁদের পর্দা ফাঁস করবেন বলে বারে বারেই হুঙ্কার ছেড়েছেন কুণাল ঘোষ। কখনও অভিযোগ তুলেছেন, তাঁকে বলতে দেওয়া হচ্ছে না। কখনও বা মোক্ষম গোলাগুলি ছুড়েছেন শাসক দলের নেতানেত্রী ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। অথচ শুক্রবার ক্রীড়া ও পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র যখন সিবিআইয়ের মুখোমুখি, সেই কুণালই বেবাক চুপ। অনেকটাই ভাবলেশহীন দেখিয়েছে তাঁকে।
যদিও তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড হওয়া ওই সাংসদ যাতে আর কোনও রকম বাক্যবোমা ফাটাতে না-পারেন, তার জন্য পুলিশের তরফে উদ্যোগ-আয়োজনের খামতি ছিল না আদৌ। কুণালের মুখ আটকাতে এক জন ডেপুটি কমিশনার (ডিসি), এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার (এসি), ছ’জন ইনস্পেক্টর এবং তাঁদের সঙ্গে জনা পঞ্চাশ কনস্টেবল এ দিন মোতায়েন ছিলেন ব্যাঙ্কশাল আদালত চত্বরে। সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে সারদা কাণ্ডের ওই অভিযুক্তকে দূরে রাখতে এ দিনও মূলত বাহুবলের উপরেই ভরসা রেখেছিল লালবাজার।
আদালত-চত্বরে ঢোকা এবং বেরোনোর সময় কুণালের কণ্ঠস্বর চাপা দেওয়ার জন্য পুলিশের ভ্যানের গায়ে ধাঁই-ধপাধপ চাপড় মারা আর হা-রে-রে-রে চিৎকারের রাস্তাই নিয়ে আসছেন আইনরক্ষকেরা। এ দিনও নগর দায়রা আদালতে চিৎকার দিয়ে বন্দির বক্তব্য চাপা দেওয়ার সেই রাস্তা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অন্যান্য
দিনের মতো কুণাল এ দিন সরব ছিলেন না। তবে কোনও ঝুঁকি নেয়নি পুলিশ। কুণাল যাতে সরকার-বিরোধী বেফাঁস কিছু বলে না-ফেলেন, সেই জন্য শেষ বেলায় কার্যত বগলদাবা করে তাঁকে গাড়িতে তুলে দেন পুলিশকর্মীরা। তখনও মদনবাবু গ্রেফতার হননি ঠিকই। কিন্তু সিবিআইয়ের দফতরে তাঁর জেরা পর্ব চলছিল পুরোদমে। তবু সদামুখর কুণাল এ দিন নির্বাক।
লালবাজার সূত্রের খবর, কুণালের কথা যাতে সংবাদমাধ্যমের কাছে না-পৌঁছয়, সেই জন্য পুলিশ আট ঘাট বেঁধেই নেমেছিল। এ-সব দেখে কলকাতা পুলিশেরই এক কর্তার মন্তব্য, “সাধারণত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কোনও ঘটনা ঘটলেই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।” কিন্তু কুণাল চুপ মেরে গেলেন কেন?
কুণালের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, শরীর ভাল না-থাকায় ওই সাংসদ এ দিন সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খোলেননি। আদালতেও চুপ করেই ছিলেন। এজলাসে মাঝেমধ্যেই তাঁকে চোখ বুজে থাকতে দেখা গিয়েছে।
এর আগে মামলার শুনানির দিন থাকলে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে তোপ দাগার জন্য আদালতে যাতায়াতের সময় ও কোর্ট-চত্বরকেই বেছে নিতেন কুণাল। তাঁর পথে হেঁটে প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খানও মুখ্যমন্ত্রীকে কখনও ‘ডাকাতরানি’ বলেছেন, কখনও বলেছেন ‘মুকুল-মদন জেলে যাবে’। সিবিআইয়ের ডেরায় সেই মদনবাবুর জেরার দিনে কুণাল নীরব কেন, উঠছে প্রশ্ন।
এ দিন নগর দায়রা আদালতে সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মামলায় সিবিআই আদালতের বিচারক অরবিন্দ মিশ্রের এজলাসে তোলা হয় কুণাল, সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন এবং দেবযানী মুখোপাধ্যায়কে। কুণালের আইনজীবী অভিযোগ করেন, মামলার চার্জ গঠনের জন্য সব অভিযুক্তকে যথাযথ ভাবে ‘সমন’ পাঠায়নি সিবিআই। আদালতের বাইরে কুণালের আইনজীবী অয়ন চক্রবর্তী বলেন, “সিবিআইয়ের দেওয়া চার্জশিটে অভিযুক্তের তালিকায় আট নম্বরে নাম রয়েছে কুণালের সংস্থা ‘স্ট্র্যাটেজিক মিডিয়া’র। অথচ ওই সংস্থায় ‘সমন’ পাঠানোই হয়নি।” সিবিআইয়ের আইনজীবী আদালতে জানান, ওই সংস্থার কর্ণধার হিসেবে কুণাল সমন নিতে অস্বীকার করেছেন। দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে বিচারক সিবিআই-কে ফের সমন পাঠানোর নির্দেশ দেন।
দেবযানীর আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতা আদালতে বলেন, “সিবিআই যে-মামলা দায়ের করেছে, তাতে অভিযুক্ত হিসেবে মনোজ নাগেলের নাম রয়েছে। অথচ চার্জশিটে তাঁর নাম নেই। সে-ক্ষেত্রে তাঁকে ওই মামলায় রেহাই দেওয়ার কথা। অথচ তাঁকে দীর্ঘদিন আদালতে তোলা হয়নি।” বিচারক সিবিআইয়ের আইনজীবীর কাছে বিষয়টি জানতে চান। সিবিআইয়ের আইনজীবী পার্থসারথি দত্ত বলেন, ওই মামলার তদন্ত এখনও চলছে। তাই এখনই বলা যাবে না, নাগেল নির্দোষ। এই জবাবে সন্তুষ্ট হতে না-পেরে বিচারক ওই মামলার তদন্তকারী অফিসারকে আদালতে ডেকে পাঠান। শেষ পর্যন্ত সব শুনে নাগেলের বর্তমান অবস্থান নিয়ে তদন্তকারী অফিসারকে রিপোর্ট পেশের নির্দেশ দেন বিচারক।
কুণাল, সুদীপ্ত ও দেবযানীকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy