Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

খাগড়াগড়ের তদন্ত-সূত্রে মুজাহিদিনের আজমগড়

তদন্ত যত এগোচ্ছে, মিলছে নিত্যনতুন যোগসূত্র। বর্ধমান-বিস্ফোরণে এ বার উঠে এল ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)-এর আজমগড় প্রশিক্ষণকেন্দ্রের (মডিউল) নাম। এনআইএ-র দাবি: খাগড়াগড়ের বাড়িটিতে বিস্ফোরণের ঘটনায় যে চক্র জড়িত, তার অন্যতম মাথা ইউসুফ শেখ দফায় দফায় বছর চারেক আজমগড়ে কাটিয়েছে। সেখানে সে অস্ত্রচালনা ও জেহাদি তালিম নেয়। বর্ধমানের মঙ্গলকোটের বাসিন্দা যুবকটি অবশ্য খাগড়াগড়-কাণ্ডের পরেই গা ঢাকা দিয়েছে।

অত্রি মিত্র
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১৫
Share: Save:

তদন্ত যত এগোচ্ছে, মিলছে নিত্যনতুন যোগসূত্র। বর্ধমান-বিস্ফোরণে এ বার উঠে এল ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)-এর আজমগড় প্রশিক্ষণকেন্দ্রের (মডিউল) নাম।

এনআইএ-র দাবি: খাগড়াগড়ের বাড়িটিতে বিস্ফোরণের ঘটনায় যে চক্র জড়িত, তার অন্যতম মাথা ইউসুফ শেখ দফায় দফায় বছর চারেক আজমগড়ে কাটিয়েছে। সেখানে সে অস্ত্রচালনা ও জেহাদি তালিম নেয়। বর্ধমানের মঙ্গলকোটের বাসিন্দা যুবকটি অবশ্য খাগড়াগড়-কাণ্ডের পরেই গা ঢাকা দিয়েছে। তদন্তকারীদের অভিযোগ, এ রাজ্যে জামাতের সংগঠন বিস্তারের প্রধান কারিগর ছিল সে-ই। আর তার স্ত্রী আয়েষা ছিল জেহাদি প্রমীলাবাহিনীকে জঙ্গিপনার পাঠ দেওয়ার দায়িত্বে। সে-ও আপাতত ফেরার।

আর আজমগড়ের তালিমই ইউসুফকে পাকাপোক্ত জঙ্গি করে তোলে বলে দাবি করছেন গোয়েন্দারা। ওঁদের বক্তব্য: ২০০৪ সাল থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে মোট প্রায় চার বছর আজমগড়ে জঙ্গি কাজকারবার ও জেহাদি ধর্মশিক্ষার প্রশিক্ষণ নিয়ে ইউসুফ শেষমেশ নিজের জেলা বর্ধমানে এসে ঘাঁটি গেড়েছিল। তার পরে সে রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে জেহাদি-জাল ছড়ানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে। বর্ধমান তো বটেই, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বীরভূমেও মূলত তার তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবির ও ঘাঁটি। গোয়েন্দাদের দাবি, মঙ্গলকোটের কৃষ্ণবাটী গ্রামের এই যুবকের উদ্যোগেই শিমুলিয়া মাদ্রাসায় অস্ত্র প্রশিক্ষণের পর্ব চলেছে দীর্ঘ দিন।

পশ্চিমবঙ্গে জেহাদি-জঙ্গি কার্যকলাপের প্রেক্ষাপটে আজমগড়ের অবস্থান ঠিক কী রকম?

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা মহলের ব্যাখ্যা: ভারতের জঙ্গি-মানচিত্রে উত্তরপ্রদেশের আজমগড় এই মুহূর্তে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম। দাউদ ইব্রাহিম থেকে শুরু করে হাজি মাস্তান, আবু সালেম থেকে ইরফান গুগনা বা সালিম চিকনার মতো ‘ডন’দের উত্থানভূমি হল আজমগড়। নব্বই দশকের শেষাশেষি এখানে সন্ত্রাসবাদীদেরও ঘাঁটি গড়ে ওঠে। ২০০৭-এর পরে ভারতের মাটিতে নাশকতার ক্ষেত্রে যে দেশজ জঙ্গি সংগঠনটির নাম সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়, সেই ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের উগ্রপন্থা প্রশিক্ষণের প্রধান দু’টি কেন্দ্র আজমগড় ও কর্নাটকের ভটকল। ভটকলে গড়ে ওঠা কেন্দ্রটির কারিগর আইএমের প্রতিষ্ঠাতা দুই ভাই রিয়াজ ভটকল ও ইকবাল ভটকল। তাদের নামানুসারে সেটি ‘ভটকল মডিউল’ হিসেবে গোয়েন্দামহলে পরিচিত। গোয়েন্দাদের দাবি, মূলত পাকিস্তানি চরসংস্থা আইএসআইয়ের অঙুলিহেলনে ভটকল মডিউল চালিত হয়।

আর ‘আজমগড় মডিউল’-এর সঙ্গে আল কায়দার বর্তমান নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের অভিমত। তাঁরা জানাচ্ছেন, আইএম পত্তনের পরে বারাণসী বিস্ফোরণ, আমদাবাদ বিস্ফোরণ বা দিল্লির বাটলা হাউসের মতো নানা জঙ্গি হামলায় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে আজমগড় মডিউল। যেমন, আজমগড়ে প্রশিক্ষিত আবু বাসার আমদাবাদ বিস্ফোরণের মূল চক্রী। আবার বাটলা হাউস-কাণ্ডে ধৃত মহম্মদ সঈদ, শাহজাদ আহমেদ ও নিহত আতিফ আমিন-ও আজমগড় মডিউল থেকে উঠে এসেছে। গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: বর্তমানে আইএমের আজমগড় মডিউলের মাথায় রয়েছে ‘ডক্টর’ শাহনওয়াজ। আজমগড়ের বাসিন্দা তথা ভটকল-ভাইদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এই ব্যক্তিই সাম্প্রতিক অতীতে দিল্লির বুকে ঘটে যাওয়া প্রায় সব ক’টি জঙ্গি হামলার পাণ্ডা বলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের ধারণা। প্রসঙ্গত এ দেশে একাধিক নাশকতার সঙ্গে আইএমের ‘দ্বারভাঙা মডিউল’-এর নামও জড়িয়েছে।

তবে জঙ্গিপনার তালিম নেওয়ার জন্য ইউসুফ আজমগড়কেই বেছে নিয়েছিল বলে এনআইএ এখন জানতে পেরেছে। যে কারণে তাদের চিন্তাও বেড়েছে। “পশ্চিমবঙ্গে জেহাদি-জঙ্গি নেটওয়ার্ক ছড়ানোর কাজে ইউসুফ ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। তার পিছনে আজমগড়ের ট্রেনিং থাকার খবরটা উদ্বেগজনক বইকি!” মন্তব্য এক অফিসারের।

ইতিমধ্যে খাগড়াগড়-কাণ্ডে ধৃত রাজিয়া বিবি, আলিমা বিবি এবং জখম আব্দুল হাকিমকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে এনআইএ জেরা করেছে। তাদের দাবি: আলিমা, রাজিয়া জানিয়েছে, ইউসুফের স্ত্রী আয়েষার কাছ থেকেই তারা শিমুলিয়া মাদ্রাসায় অস্ত্রচালনা ও বিস্ফোরকের তালিম পেয়েছে। তারা এ-ও কবুল করেছে যে, জঙ্গিদের পুরো ওই ‘কর্মযজ্ঞের’ হোতা ছিল ইউসুফ, আর তার ডান হাত ছিল হাতকাটা নাসিরুল্লা। আয়েষা কোথায় জেহাদি তালিম নিয়েছে, ইউসুফের মতো সে-ও ভিন রাজ্যের কোনও শিবিরে শিক্ষার্থী ছিল কিনা, গোয়েন্দারা তা খতিয়ে দেখছেন।

ভটকল-ভাইয়েরা এখনও ধরা পরেনি। ডক্টর শাহনওয়াজও নাগালের বাইরে। তবে ২০০৭-এ আইএমের নাম সামনে আসা ইস্তক সংগঠনের একাধিক নেতা এনআইএ বা পুলিশের জালে পড়েছে। এবং তাদের অনেকেই আজমগড় মডিউলের ফসল। ইউসুফের হাল-হকিকত আরও বিস্তারিত জানতে গোয়েন্দারা তাদের জেরা করার কথাও ভাবছেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE