Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত নলিনী বেরা

তাঁর ৬৭ বছর বয়সি দেওরের কথা বলছিলেন প্রৌঢ়া, ‘লেখাপড়ায় ওর বরাবরই মাথা। এখান থেকে বারো কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেত।’

পুরস্কৃত: নলিনী বেরা

পুরস্কৃত: নলিনী বেরা

গৌতম চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০১:৪৯
Share: Save:

বৈশাখ মাসের দুপুরে, গাছের ছায়ায় নাতিপুতিদের নিয়ে বসে ছিলেন বিধবা প্রৌঢ়া। তাঁর সামনে জাবনা খাচ্ছে একটা গরু।

গোপীবল্লভপুর থেকে গ্রামের রাস্তায় ডুলুং নদীর দিকে বেশ কিছুক্ষণ এগোলে বাছুরখোঁয়াড় গ্রাম। মাত্র পাঁচ বছর আগে এখানে বিদ্যুৎ এসেছে।

তাঁর ৬৭ বছর বয়সি দেওরের কথা বলছিলেন প্রৌঢ়া, ‘লেখাপড়ায় ওর বরাবরই মাথা। এখান থেকে বারো কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেত।’ মেধাবী ছোট ভাইকে মেদিনীপুর কলেজে ভর্তি করতে গিয়ে এই প্রৌঢ়ার স্বামীকে একদা পাঁচ কাঠা চাষের জমিও বিক্রি করে দিতে হয়েছিল।

সেই দেওর, নলিনী বেরাই ‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ উপন্যাসের জন্য ১৪২৫ সালের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত। পুরস্কারের দৌড়ে ছিল আরও দু’টি বই— সন্মাত্রানন্দের ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ এবং ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তীর ‘মনোরথের ঠিকানা’। চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে পাঁচ বিচারক— অংশুমান কর, উমা দাশগুপ্ত, বিভাস চক্রবর্তী, বেগম আকতার কামাল এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় নলিনীবাবুর সুবর্ণরেখাকেই জয়টিকা পরিয়েছেন। পুরস্কারের খবর পেয়ে লেখক বলেছিলেন, ‘আজ গ্রামের লোকেদের কথা খুব মনে পড়ছে। আমার লেখা সেখানকার মানুষজনকে নিয়েই।’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

নদী নিয়ে বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস কম নেই। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’ থেকে দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, অনেক নামই করা যায়। মানিক বা সমরেশের উপন্যাসে সে রকম আত্মজৈবনিক উপাদান নেই। মানিক এক বার অনুজ লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে বলেওছিলেন, ‘উপন্যাস লেখার আগে মাঝিদের সঙ্গে জাল ফেলতেও যাইনি। দু’এক দিন বিড়িটিড়ি খেয়েছি মাত্র।’

বিচারকমণ্ডলী: বেগম আকতার কামাল, বিভাস চক্রবর্তী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, অংশুমান কর এবং উমা দাশগুপ্ত। ছবি: সুমন বল্লভ

কিন্তু নিম্নবর্গের মালোসন্তান অদ্বৈত মল্লবর্মণ? তাঁর তিতাস এই সুবর্ণরেখার মতোই। গঙ্গা বা পদ্মার মতো ব্যাপ্তি তার ছিল না। কিন্তু নদীর ধারের জনজীবন নিয়ে লেখা সেই উপন্যাস আজও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মাস্টারপিস। নলিনীবাবুদের বাড়ির চালে আজও বাঁধা রয়েছে মাটির বড় জালা, সেখানে পায়রারা ঝাঁক বেঁধে থাকে। ‘‘আমাদের গ্রামে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ বিশেষ ছিল না। কিন্তু অন্ত্যজ পরিবারগুলিও জাতপাত থেকে রেহাই পায়নি। ছেলেবেলায় এক বন্ধুর বাড়ি নেমন্তন্নে গিয়েছি। খাওয়ার পর সে বলল, তোর থালাটা মেজে দিয়ে যাস। চোখে জল নিয়ে পুকুরপাড়ে গিয়েছিলাম,’’ বলছিলেন কুম্ভকার পরিবারের সন্তান।

‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ কি শুধুই নদীর ধারে এক গ্রামের জীবন? এখানে আকাশে জয়পাখি উড়ে যায়। উপন্যাসের নায়ক ছোট্ট নলিন ‘জয়ের জন্য একটা পালক দাও না’ বলতে বলতে ছোটে। এই জয়পাখিরই তো আর এক নাম নীলকণ্ঠ। ঝটিতি পাঠকের মনে হানা দেয় দেশভাগের সময় পূর্ব বাংলার আর এক বালক— সোনা। তার জেঠামশাই উন্মাদ মণীন্দ্রনাথের মনে হয়, আকাশে তাঁর পোষা হাজার হাজার নীলকণ্ঠ পাখি হারিয়ে গিয়েছে। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ব্রাহ্মণ পূর্বজ এবং রুক্ষ ঝাড়গ্রাম, গোপীবল্লভপুর থেকে উঠে আসা কুম্ভকার অনুজও সাহিত্যের আকাশে নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেন, এখানেই আধুনিক বাংলা উপন্যাসের চলমান চমৎকৃতি। ১৪২৫ সালের আনন্দ পুরস্কার সেই চলিষ্ণুতাকেই অভিবাদন জানিয়েছে।

নলিনীও জীবনের স্রোত বেয়েই বিভিন্ন বাঁকে এগিয়েছেন। একদা রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে নকশাল আন্দোলন, ১৯৭৯ সালে জীবনের প্রথম ছাপা গল্প দেশ পত্রিকায়— ‘বাবার চিঠি’। বাকিটা ইতিহাস। সুবর্ণরেখার ধারে, বাছুরখোঁয়াড় গ্রামে ছেলেবেলায় যাঁকে খিদের জ্বালায় শুকনো তেঁতুল আর মহুলবিচি সেদ্ধ খেতে হত, পরে তিনিই রাজ্যের খাদ্য সরবরাহ দফতরে পদস্থ আধিকারিক। জীবন মাঝে মাঝে সাহিত্যকেও হার মানায়।

এই বই আত্মজীবনী নয়, উপন্যাস। উপন্যাসের ছোট্ট নায়ক নলিন আর লেখক নলিনী বেরা এক কি না, সেই তর্ক অবান্তর। ‘অল রাইটিং ইজ অটোবায়োগ্রাফি’, লিখেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক জে এম কোয়েটজি। নলিনী বেরার ‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ সেই অভিজ্ঞতা আর জীবনবোধের স্রোত বেয়েই পৌঁছে গেল আনন্দ-সম্মানের উজানে।

অন্য বিষয়গুলি:

Nalini Bera Literature Ananda Puraskar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE