প্রতীকী ছবি।
মা, মেঘ করেছে কিন্তু
—হুঁ, ছাতাটা নিলে হত রে!
বাড়ি থেকে কিছুটা চলে আসার পরে আকাশের ঘন ছায়াটা খেয়াল করল দীপ্তি। ভর বিকেলেও গলির মুখটা আঁধার করে আছে। মেয়েটা আজ তার হাত ছাড়িয়ে হাঁটছে। বিকেলের মেঘ-ছায়ায় কেমন অচেনা লাগে তাকে। একটা বছরে কেমন নিশ্চুপে বড় হয়ে গেল টুম্পা।
সামনে হাফ ইয়ার্লি, ভিজলে আবার ফ্যাঁচফ্যাঁচ, জ্বর ঠেলে স্কুলে পাঠাতে তখন বড় অস্বস্তি হয়। দীপ্তি ভাবে— ফিরে যাবে, আলমারির মাথা থেকে নামিয়ে আনবে ছাতাটা? গলি ছাড়িয়ে মিঠু কাকিমার বোগেনভেলিয়া ঢাকা পাঁচিলের বাঁকটা ঘুরলেই তো তাদের শ্যাওলা পড়া দেওয়াল। কতটুকু আর, এক ছুটে নিয়েই আসবে, নাকি অপুকে ফোন করে....
তাক থেকে হুড়মুড়িয়ে এক গোছা কাঁসার বাসন যেন ঝমঝম করে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে...মাথার মধ্যে কিলবিল করতে থাকে অজস্র জলজ নদী...এ কি করল সে, এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল সব!
আলমারির মাথা থেকে পুরনো ধুলোর আস্তরণ সন্তর্পণে এড়িয়ে আস্তিন গোটানো পাঞ্জাবির হাতটা নামিয়ে আনছে তার শিক ভাঙা কালো ফোল্ডিং ছাতাটা...দু’বছর আগে, সেই সহজ ছবিটা যেন মেঘ-বিকেলে বড় অ-সহজ হয়ে গলার কাছে দলা পাকানো কান্নার মতো আটকে গেল দীপ্তির। ঠোঁট কামড়ে সহজ হওয়ার চেষ্টা করে। বাতাসে জলের গন্ধ, পালপাড়ার আকাশ ফালা ফালা করে ঝলসে ওঠে নিঃসঙ্গ বিদ্যুৎ। তার পর, দূরের মাঠে ভেঙে পড়া বাজ স্মৃতির মতো যেন গুড়গুড় করে বয়ে আনে হারানো কিছু শব্দ, ‘একটা লেবু গাছ লাগালে হয় না!’
বড় রাস্তার উপরে ইতি-উতি উল্টো রথের ভিড়। আদুরে বাচ্চাদের নড়বড়ে রথ নিয়ে পাড়ার ইট পাতা রাস্তায় টলমলে টহল দেখলেই সন্ধেটা এখন গিলে খেতে আসে তাকে, তালপাতার ভেঁপু গলির গা ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ির দেওয়ালে ঠোক্কর খেতে থাকলেই সপাটে জানলা বন্ধ করে দীপ্তি। বড় অভিমান, মনে হয় জগন্নাথের পায়ের সামনে টিমটিমে মোমবাতিটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয়। তাদের আড়াই জনের সংসারে, গেলো বার এমনই এক উল্টোরথের দুপুরে যেমন ঝুপ করে নিভে গিয়েছিল সুখ-দুঃখের মোম-আলোটা।
—মা
হাতটা এগিয়ে ধরেছে টুম্পা। সরু কব্জির উপরে টলটল করছে একটা জল-ফোঁটা।
—দেখলে তো, এ বার ভিজতে হবে!
উত্তর দেয় না দীপ্তি। থাক, না হয় ভিজবে। ভিজে, পুড়ে, শুকিয়ে এক সময় ঠিক বড় হয়ে উঠবে। দীপ্তি মেয়ের হাতটা ধরে, ‘চল পা চালা দেখি।’ চাঁপাইতলার মাঠে উল্টোরথের মেলাটা এখনও নিভু নিভু করে জেগে আছে। ভাঙা মেলায় আজ একটা লেবু চারার খোঁজ করবে সে।
একটা বছর আগে লাগালে আষাঢ়ের জলে গাছটা নিশ্চয়ই এত দিনে ডালপাতালা ছড়িয়ে ডানপিটে হয়ে উঠত। অপুর ভারী শখ ছিল লেবু গাছের, নিজে হাতে পিছনের এক ফালি বাগানে লাগালে...‘দু-তিন বর্ষাতেই জানলার মাথা ছুঁয়ে ফেলবে, কি বল?’ চশমার কাচ মুছতে মুছতে সে বার বলেছিল অপু। আলগোছে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার, দীপ্তি ভাবে, কে যে কাকে ছোঁয়...
অপুর সেই বাগানে এখন উইয়ের ঢিপি, আগাছার ভিড়ে তক্ষকের ঘরবসত। শীর্ণ আম গাছে মুকুল আসেনি এ বার। জানলার রডে সিপিয়া ছবির মতো আদিম মর্চে। তাদের দু’কামরার দমবন্ধ ঘরে ষাট ওয়াটের নেই নেই আলোয় দুলে দুলে কবিতা মুখস্থ করে টুম্পা, ‘ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত...’
গেলো বারের সেই আষাঢ় যেন তার আটপৌরে জীবন থেকে অনেক এলোমেলো সুখ ধুয়ে মুছে নিয়ে গেছে। সে আষাঢ়ে মেঘ এসেছিল, বৃষ্টিও ছিল, রথের বিকেলে ঠোঙা উপচানো পাঁপড় এসেছিল বাড়িতে। শুধু, উল্টোরথের বিকেলে চাঁপাইতলার মেলায় লেবু চারা খুঁজতে যাওয়ার আগে, তাদের পলেস্তরা খসা বাড়ির দেওয়ালে সশব্দে আছড়ে পড়েছিল খবরটা। মাড় গালা ভাতের হাঁড়িটা নামানোর ফাঁকেই সাইকেলের অধৈর্য ঘণ্টিটা যেন কু ডাকের মতো বেজে চলেছিল সে দিন।
কি গো, এত তাড়া কিসের?
আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসেছিল দীপ্তি। গ্রিলের গায়ে সাইকেলটা ঠেস দিয়ে বড় বড় ঢোঁক গিলছে গোবিন্দ, অপুদের শ্রীগুরু লেদ কারখানার ইলেকট্রিক মিস্তিরি।
কি গো, গোবিন্দ, এমন করছ কেন!
দু’হাতে গ্রিল আঁকড়ে গোবিন্দ হাঁউমাউ করে ওঠে, —বৌদি গো, হাসপাতালে যেতি হবে, দাদার অ্যাকছিডেন্ট হইছে...!
পাড় ভাঙা নালার মতো গোবিন্দ হুড়মুড়িয়ে বলতে থাকে ....‘লেদ মেশিনে দাদার হাত দু’টো সেঁদিয়ে... সে কি কাণ্ড গো...’ ঠোঁট নড়ছে মানুষটার, এতোল বেতোল এক টানা বলে চলেছে, মেঘ মেঘ দুপুরটা কেমন গলতে শুরু করেছে, দীপ্তি কিছুই শুনতে পাচ্ছে না আর, মনে হচ্ছে, অগুন্তি রথের ভেঁপুতে তার কান দু’টো অবশ হয়ে আসছে, একটা ধূসর হাওয়ার ঘূর্ণী তাকে ধীরে ধীরে গিলে নিচ্ছে তাকে...
পাড়-ছেঁড়া শাড়িতেই সে দিন সদর হাসপাতালে পৌঁছেছিল দীপ্তি। রিকশা থেকে নেমে ভাড়াটাও দিতে ভুলে গিয়েছিল দীপ্তি। আর, এমারজেন্সির স্ট্রেচারের সামনে ভুতগ্রস্থ চেহারায় পৌঁছে দেখেছিল, বিস্ফারিত চোখে অপু এক টানা বলে চলেছে, ...‘আমার হাত দু’টো, হাত দু’টোর কি হল গো...’ কনুইয়ের নীচ থেকে কলাগাছের মতো পুরু ব্যান্ডেজে ঢাকা ছিন্ন হাত, উল্টোরথের দুপুরে জগন্নাথ হয়ে গেছে তার অপু!
এক ফালি জমি, মফসসলের রাস্তা-গলি ঠেলে খোলা ড্রেনের পাশে তাদের আটপৌরে বাড়িতে তেত্রিশ দিন পর হাসপাতাল থেকে ফিরল অপু। তার পর, জানলার গা ঘেঁষা তাদের রং চটা চৌকির উপরে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকল খানিক। অস্ফূটেই বুঝি, কাকে যেন বলল, ‘‘লেবু গাছটা আর নিজে হাতে লাগানো হল না গো আমার!’’...
একটা ভাঙাচোরা বছর পরে, গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উল্টোরথের মেলায় পৌঁছে দীপ্তি দেখল, চাঁপাইতলার মাঠটটা যেন অজস্র ভিজে ভিজে লেবু চারায় ভরে গিয়েছে...।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy