Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
BJP

বিধানসভায় বড় ভরসার টিগ্গাকে হারাবেন শুভেন্দু! জেলা সভাপতি বাছাইয়ের নেপথ্যে সুকান্তের অঙ্ক কী?

জেলা সভাপতিদের নামের নতুন তালিকা রবিবার প্রকাশ করেছে রাজ্য বিজেপি। এত দিন জেলা সভাপতিদের মধ্যে মাত্র এক জন বিধায়ক ছিলেন। এ বার সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ছয়।

বিধানসভার মুখ্য সচেতক মনোজ টিগ্গা এখন আলিপুরদুয়ারের জেলা সভাপতি।

বিধানসভার মুখ্য সচেতক মনোজ টিগ্গা এখন আলিপুরদুয়ারের জেলা সভাপতি। — ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২৩ ১৯:১৯
Share: Save:

মাদারিহাটের বিজেপি বিধায়ক মনোজ টিগ্গা এখন বিধানসভায় গেরুয়া শিবিরের মুখ্য সচেতক। কিন্তু তাঁকেই আলিপুরদুয়ার জেলার নতুন সভাপতি করেছেন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। এর পরেই প্রশ্ন উঠছে, তবে কি মুখ্য সচেতক পদে অন্য কেউ আসবেন? কারণ, বিজেপি ‘এক নেতা, এক পদ’ নীতিতে বিশ্বাস করে। সেই হিসাবে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী কি অত্যন্ত ভরসার মনোজকে হারাবেন? রবিবার এই প্রশ্নে মনোজ বলেন, ‘‘দল যা ঠিক করবে, তা-ই হবে। আমি কিছু বলতে পারব না।’’ সোমবার একই প্রশ্ন সুকান্তকে করা হলে তিনি বলেন, ‘‘মনোজই মুখ্য সচেতক থাকছেন।’’

২০১৬ সালে মাদারিহাট থেকে জিতে বিধানসভায় আসেন মনোজ। একই সময়ে বিজেপির তৎকালীর রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও খড়্গপুর বিধানসভা থেকে বিধায়ক হন। কিন্তু ২০১৯ সালে দিলীপ সাংসদ হয়ে গেলে মনোজ একাই বিজেপি পরিষদীয় দল সামলান। সেই সময়ে উপনির্বাচনে বিজেপির বিধায়ক বৃদ্ধি হওয়ায় মনোজ দলেও ভারী হয়েছিলেন। পরে তৃণমূল থেকেও কয়েক জন বিধায়ক বিজেপিতে আসেন। সেই বর্ধিত পরিষদীয় দলের নেতৃত্ব দেন মনোজ। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ৭৭ আসনে জয় পেলে বিরোধী দলনেতা পদ যেমন শুভেন্দুই পাবেন বলে ঠিক ছিল, তেমনই মুখ্য সচেতক হিসাবে দলের প্রথম পছন্দ ছিলেন মনোজ। শুধু দু’বারের বিধায়ক হিসাবে মনোজের অভিজ্ঞতাই নয়, সেই সঙ্গে বিজেপির আদি নেতা এবং সঙ্ঘ পরিবার-ঘনিষ্ঠ হিসাবেও পরিচিত মাদারিহাটের বিধায়ক।

বর্তমানে শুভেন্দুর বড় ভরসা মনোজ। দলের পক্ষে ‘হুইপ’ জারি থেকে বিরোধী দলনেতার অনুপস্থিতিতে পরিষদীয় দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজ কিংবা বিধানসভা সচিবালয়ের কাজে মূল দায়িত্ব পালন করেন মনোজ। শুভেন্দুর সঙ্গে তাঁর মিলতালও ভাল। সেই মনোজকে জেলা সভাপতির দায়িত্ব দেওয়ার পরেই নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।

উপরে (বাঁ দিক থেকে) মনোজ টিগ্গা, পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায়, অমরনাথ শাখা। নীচে বিমান ঘোষ, তাপসী মণ্ডল এবং অরূপকুমার দাস।

উপরে (বাঁ দিক থেকে) মনোজ টিগ্গা, পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায়, অমরনাথ শাখা। নীচে বিমান ঘোষ, তাপসী মণ্ডল এবং অরূপকুমার দাস। — ফাইল চিত্র।

বিজেপিতে সাধারণ ভাবে পরিষদীয় দল ও সংগঠন আলাদা ভাবে চলে। জনপ্রতিনিধিরা কোনও পরিষদীয় পদে থাকলে তিনি আর দলীয় পদ পান না। সেটা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রের মতো রাজ্যেও প্রযোজ্য। উদাহরণ ধর্মেন্দ্র প্রধান। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ায় তাঁকে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদ ছাড়তে হয়েছিল। সেই হিসাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার সময় অমিত শাহকে সর্বভারতীয় সভাপতি পদ ছাড়তে হত। যদিও তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেটা ছাড়েননি। তবে সেই সময়ে জেপি নড্ডাকে কার্যকরী সভাপতি এবং পরে সভাপতি করা হয়।

রাজ্য বিজেপিতেও দু’রকমের উদাহরণ রয়েছে। দিলীপ রাজ্য সভাপতি থাকার সময়ে বিধানসভায় দলের পরিষদীয় নেতা হন। পরে সেই দায়িত্ব মনোজ পান। আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার পরে বাঁকুড়ার সাংসদ সুভাষ সরকারকে রাজ্যের সহ-সভাপতি পদ ছেড়ে দিতে হয়। বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, দল ‘একে নেতা, এক পদ’ নীতি মেনে চললেও সেটা সাংগঠনিক সংবিধানে বলা নেই। সেই কারণে, বিশেষ প্রয়োজনে সভাপতি এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সেই হিসাবেই মনোজকে দুই পদে রাখতে চান সুকান্ত। তিনি বলেন, ‘‘আমরা আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। উনি দলের পুরনো লোক। কাজের মানুষ। একই সঙ্গে দুই দায়িত্বই তিনি পালন করতে পারবেন বলে বিশ্বাস রয়েছে দলের।’’

যদিও বিজেপি শিবিরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে মনোজকে আলিপুরদুয়ারের জেলা সভাপতি করার পিছনে অন্য অঙ্ক রয়েছে গেরুয়া শিবিরের। গত লোকসভা নির্বাচনে আলিপুরদুয়ার জেতার পরে বিধানসভা নির্বাচনেও ওই জেলায় ভাল ফল করে বিজেপি। অন্য দিকে, আগামী লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আলিপুরদুয়ারে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে তৃণমূল। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই আলিপুরদুয়ার বিধানসভা আসনে জয়ী বিজেপি বিধায়ক সুমন কাঞ্জিলাল তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। দলের জেলা সভাপতি প্রকাশ চিক বরাইককে রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, উত্তরবঙ্গের বিশেষ করে আলিপুরদুয়ারের আদিবাসী ভোটে দলের প্রভাব বাড়াতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূল। তার পাল্টা নিজেদের শক্তি ধরে রাখতে এলাকায় প্রভাব রয়েছে এমন আদিবাসী নেতা হিসাবেই মনোজকে জেলা সভাপতি হিসাবে বেছেছেন সুকান্ত।

সুকান্ত রাজ্য সভাপতি হওয়ার পরে এক বার জেলা সভাপতি বদল করেছিলেন। তখন অনেক অভিযোগ উঠেছিল। এ বার যাতে সেটা না হয় তার জন্য অনেক ভেবেচিন্তে দলের পুরনো এবং নতুনদের সমান গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে জেলা সভাপতি বাছাইয়ে। সকলের সঙ্গে আলোচনাও করা হয়েছে। বিজেপি শুধু মনোজ নয়, মোট ছ’জন বিধায়ককে জেলা সভাপতি করেছে। গেরুয়া শিবির সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বিষয়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর সঙ্গে আলোচনা করেছেন সুকান্তেরা। আর মনোজের মতো বাকি পাঁচ বিধায়ক বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্ক।

নদিয়া দক্ষিণে আগে থেকেই জেলা সভাপতি ছিলেন রানাঘাট উত্তর-পশ্চিমের বিধায়ক পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়। এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে অন্যান্য জেলার তুলনায় নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলায় ভাল ফল করেছে বিজেপি। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগেই শুভেন্দুর হাত ধরে বিজেপিতে যোগ দেন পার্থসারথি। দীর্ঘ দিন রানাঘাটের পুরপ্রধান ছিলেন তিনি। এলাকায় সংগঠনের পাশাপাশি জনপ্রিয়তাও রয়েছে। বিষয়টি আগামী লোকসভা নির্বাচনে কাজে লাগাতেই তাঁকে জেলা সভাপতি রেখেছে বিজেপি।

এ ছাড়া বিজেপি জেলা সভাপতি করেছে ওন্দার বিধায়ক অমরনাথ শাখা, পুড়শুড়ার বিধায়ক বিমান ঘোষ, হলদিয়ার তাপসী মণ্ডল এবং কাঁথি দক্ষিণের অরূপকুমার দাসকে। বিজেপি গত লোকসভা নির্বাচনে বিষ্ণুপুর জিতেছিল। সেই সাংগঠনিক জেলায় সভাপতি হয়েছেন অমরনাথ শাখা। বিধায়ক হিসাবে বিধানসভার পাশাপাশি নিজের কেন্দ্র এবং জেলায় বরাবরই সক্রিয় অমরনাথ। তিনি সঙ্ঘ পরিবার-ঘনিষ্ঠ বিজেপির ‘আদি’ নেতাদের এক জন। সেই হিসাবে অমরনাথকে বাছা হয়েছে বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে। একই ভাবে দীর্ঘ দিন দলের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করা পুড়শুড়ার বিধায়ক বিমান যুব মোর্চা থেকে রাজ্য বিজেপির সম্পাদক হয়েছেন। গত লোকসভা নির্বাচনে খুব কম ভোটে বিজেপি হেরেছিল আরামবাগ আসনে। এ বার বিজেপি যে সব হেরে যাওয়া আসনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম আরামবাগ। সেখানে বয়সে নবীন বিমানকে দায়িত্ব দেওয়ার পিছনেও রয়েছে অঙ্ক। বিজেপি শিবিরে একটা সময়ে এমনও শোনা যাচ্ছিল যে, বিমান আগামী লোকসভা নির্বাচনে হুগলি জেলার কোনও আসন থেকে প্রার্থী হতে পারেন। সেই জল্পনার মধ্যেই জেলা সভাপতি হলেন তিনি।

বাকি দুই বিধায়ক হলদিয়ার তাপসী এবং কাঁথি দক্ষিণের অরূপকুমার পরিচিত শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ হিসাবেই। তাঁরা যথাক্রমে তমলুক ও কাঁথি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি হয়েছেন। তাপসী আগে সিপিএম বিধায়ক ছিলেন। শুভেন্দুর সঙ্গেই বিজেপিতে যোগ দেন ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর। আর প্রাক্তন শিক্ষক অরূপকুমার বিজেপিতে যোগ দেন গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে। যোগ দিয়েই প্রার্থী হন। অনেকে বলেন, শুভেন্দুর পছন্দেই অতীতে রাজনীতি না-করা অরূপকুমারকে প্রার্থী করেছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। প্রসঙ্গত, কাঁথি দক্ষিণেই শুভেন্দুর বাড়ি। এখন কাঁথি ও তমলুক তৃণমূলের হাতে থাকলেও সাংসদ রয়েছেন শুভেন্দুর বাবা শিশির অধিকারী ও ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই দুই লোকসভা এলাকায় বিজেপি ভাল ফলই করেছে। আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি চায়, কাঁথি ও তমলুক দখলে থাকুক। সেই কারণেই এমন দু’জনকে জেলা সভাপতি করা হয়েছে, যাঁরা সরাসরি অধিকারীদের কাছের হিসাবেই পরিচিত। তাপসীকে নিয়ে বিজেপির এমন ভাবনাও রয়েছে যে, বামের ভোট রামে আনতেও তিনি কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারেন।

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Suvendu Adhikari Sukanta Majumdar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy