অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংসদ টিভি থেকে নেওয়া।
২০১৪ সাল থেকে পর পর তিনি ডায়মন্ড হারবার লোকসভা থেকে জিতেছেন। এ বার জিতেছেন রেকর্ড ৭ লক্ষ ১০ হাজার ভোটে। তবে সংসদে তাঁর উপস্থিতির হার নিয়ে কটাক্ষ করতেন বিরোধীরা। লোকসভা অধিবেশনে তাঁর ধারাবাহিক অনুপস্থিতি নিয়ে একান্ত আলোচনায় ‘বিরক্তি’ গোপন করতেন না তৃণমূলের অনেক নেতা। কিন্তু তৃতীয় নরেন্দ্র মোদী সরকারের শুরু থেকে ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ তথা দলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সংসদে যে ভূমিকা নিচ্ছেন, তা দেখে তৃণমূলের অনেকেই মানছেন, গত ১০ বছরে এই ভূমিকায় কখনও দেখা যায়নি তাঁকে।
এতটাই যে, দলের অনেকের মতে, অভিষেকই এখন তৃণমূলের সংসদীয় দলের ‘অঘোষিত’ নেতা। তাঁর সক্রিয়তার জেরে কার্যত ম্লান লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। আর রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন দলের অন্দরে অভিষেকের ‘আস্থাভাজন’ বলেই পরিচিত।
বাজেটের উপর বক্তৃতায় তৃণমূলের তরফে অভিষেকই ছিলেন প্রথম বক্তা। বক্তৃতার আগের দিন নিজেই তা ঘোষণা করেছিলেন। সেই বক্তৃতার ‘ঝাঁজ’ নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। শুধু বক্তৃতা নয়। সংসদের বাইরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময়েও মোদী তথা বিজেপি-বিরোধিতায় যে ‘আগ্রাসী’ রূপ অভিষেক দেখাচ্ছেন, তাতে আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে গত ১০ বছরের সঙ্গে এ বারের সাংসদ অভিষেকের ফারাক।
সংসদের অধিবেশন শুরুর পর থেকেই অভিষেক নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। কখনও স্পিকার নির্বাচন নিয়ে কংগ্রেসের প্রার্থী ঘোষণা করে দেওয়াকে সোজাসুজি ‘একতরফা’ সিদ্ধান্ত বলে দিয়েছেন, আবার কখনও বলেছেন, বিজেপি তথা এনডিএ-র খাতায়কলমে যে সংখ্যা রয়েছে, তা আরও কমে যাবে এই ভয়ে স্পিকার নির্বাচনে কেবল ধ্বনিভোট নেওয়া হয়েছে। ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রে বোতাম টেপার দিকে হাঁটেনি বিজেপি।
অভিষেকের এই ভূমিকাকে দু’ভাবে ব্যাখ্যা করছে রাজনৈতিক মহল। এক, অভিষেক পরতে পরতে বুঝিয়ে দিতে চাইছেন, বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র মধ্যে কংগ্রেসের ‘দাদাগিরি’ (দিল্লির রাজনীতির পরিভাষায় ‘বিগ ব্রাদার অ্যাটিটিউড’) চলবে না। দুই, জাতীয় রাজনীতির উঠোনে তৃণমূলকে ‘প্রাসঙ্গিক’ রাখার কাজে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। আর সেই কাজে নিজে একেবারে সামনের সারিতে থাকা।
এ কথা ঠিক যে, স্পিকার নির্বাচনের সময়ে কংগ্রেসের ঘোষণাকে যে ভাবে ‘একতরফা’ বলেছিলেন অভিষেক, তাতে চাপে পড়েছিলেন রাহুল গান্ধীরাও। অনেকের মতে, সে কারণেই রাহুল কার্যত বাধ্য হয়েছিলেন অভিষেকের সঙ্গে সংসদ ভবনের ভিতরে বসে পৃথক ভাবে কথা বলতে। সেই সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও রাহুলের ফোনে কথা বলিয়েছিলেন অভিষেক। সেই আলোচনা হয়ে যাওয়ার পর অভিষেক গোঁ ধরে থাকেননি। বরং কংগ্রেসের থেকে বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে বলেছেন, ‘‘বিজেপি স্পিকার নির্বাচনে ভোটাভুটি করতে ভয় পেয়েছে।’’ রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, এই ক্ষেত্রেও অভিষেক দু’টি বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। এক, বিজেপি-বিরোধী পরিসরে তৃণমূলের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চেয়েছেন এবং দুই, পাশাপাশিই বিজেপি-বিরোধী অবস্থানে কোনও ফাঁক রাখেননি।
তবে সংসদে যে ‘নতুন’ অভিষেককে দেখা যাচ্ছে, তার নেপথ্যের কারণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তৃণমূল তো বটেই, বিজেপিরও অনেকে তাঁদের মতো করে ‘নতুন’ অভিষেকের বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তৃণমূলের এক তরুণ সাংসদের কথায়, ‘‘মাঝেমাঝে বোঝাই যাচ্ছে না, লোকসভায় আমাদের দলনেতা কে! সুদীপদা (বন্দ্যোপাধ্যায়) না কি ‘এবি’ (অভিষেকের নাম এবং পদবির আদ্যক্ষর মিলিয়ে দলে তিনি এই নামেই পরিচিত)!’’ আবার তৃণমূলের এক প্রবীণ সাংসদের কথায়, ‘‘অভিষেকের শরীরী ভাষায় স্পষ্ট, সংসদে তিনি আগের থেকে অনেক বেশি সক্রিয় থাকছেন এবং থাকবেন। এক দিকে যেমন জাতীয় রাজনীতিতে নিজেকে তুলে ধরার তাগিদ রয়েছে, তেমনই রাহুল গান্ধীর সঙ্গেও যে ‘অলিখিত’ প্রতিযোগিতা রয়েছে, তা স্পষ্ট।’’ দমদমের তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় দরাজ শংসাপত্র দিয়েছেন, ‘‘বকেয়ার দাবিতে দিল্লিতে অভিষেকের আন্দোলন এবং তার পর ব্রিগেডের সমাবেশ এবং লোকসভা ভোটের ফলাফল— অভিষেক সাফল্যের সঙ্গে তাঁর কাজ করে ফেলেছেন। এখন তিনি সংসদে যে বেশি বেশি করে সময় দেবেন সেটাই স্বাভাবিক।’’ তবে লোকসভায় অভিষেকের ১০ বছরের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ এবং এ বারের ‘সক্রিয়তা’ নিয়ে তুলনামূলক কোনও ব্যাখ্যায় সৌগত যেতে চাননি।
তৃণমূলের মতো বিজেপি-ও অভিষেকের ‘সক্রিয়তা’র উপর নজর রাখছে। শুধু তা-ই নয়। দিল্লির রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল পদ্মশিবিরের নেতারা নিজেদের মতো করে অভিষেকের ভূমিকার ব্যাখ্যা করছেন। প্রাক্তন আমলা তথা বর্তমানে জেপি নড্ডা-ঘনিষ্ঠ এক বিজেপি নেতার বক্তব্য, ‘‘গত দুই মেয়াদে আমাদের যে সংখ্যা ছিল, তাতে বিরোধীদের কথা বলাই সার হত। কিন্তু এ বার তা নয়। এ বার সংখ্যার নিরিখে আমরা কিছুটা হলেও নড়বড়ে। আমাদের শরিকি নির্ভরতা রয়েছে। আমার ধারণা, অভিষেক সেটার সুযোগ নিয়েই খোলস ছাড়ছেন।’’ এই সমীকরণ ধরেই তৃণমূলের এক প্রাক্তন সাংসদ বলেন, ‘‘রাজনীতিতে কখন কী হবে কেউ হলফ করে বলতে পারে না। এই সরকার যদি পুরো মেয়াদ না টেকে, তা হলে তৃণমূলের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হবে। হতে পারে, সেই সব অঙ্ক কষেই অভিষেক সলতে পাকানোর কাজ শুরু করে দিয়েছেন।’’
তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের প্রশ্নেও সংসদে অভিষেকের ভূমিকাকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছেন দলেরই প্রথম সারির অনেকে। দলের প্রথম সারির এক নেতার বক্তব্য, ‘‘২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে অভিষেক যা বলেছিলেন, তার দু’টি দিক রয়েছে। এক, বিনয়ী হয়েও অভিষেক বলেছিলেন, মানুষের আশীর্বাদে তৃণমূল এখন সংসদে বিরোধীদের মধ্যে তৃতীয় শক্তিধর। লোকসভা এবং রাজ্যসভা মিলিয়ে সাংসদ সংখ্যা ৪২। একই সঙ্গে তিন মাসে সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক সংস্কারের বার্তা দিয়েছিলেন। যার অর্থ স্পষ্ট— সংগঠনে তাঁর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। সাংসদ সংখ্যা নিয়ে ধর্মতলায় যা বলেছিলেন, সংসদের ভিতরে-বাইরে সেই মেজাজেরই প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন তিনি।’’
আশ্চর্য নয় যে, সংসদে সেনাপতির নতুন ভূমিকাকে তৃণমূলের অনেকেই জাতীয় রাজনীতির উঠোনে ‘অভিষেকের নবনির্মাণ’ বলে অভিহিত করছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy