মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
শুক্রবার দুপুরে জোকার ইএসআই হাসপাতালে ঢোকার সময় বলেছিলেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। কিন্তু কাদের ষড়যন্ত্রের শিকার, তা খোলসা করেননি। ঘণ্টাখানেক পরে যখন তাঁকে হাসপাতাল থেকে বার করে আনা হচ্ছে, তখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কাদের ষড়যন্ত্রের শিকার? হুইলচেয়ার-বাহিত পার্থ চট্টোপাধ্যায় তখনও কারও প্রতি আঙুল তুললেন না। শুধু বললেন, ‘‘যারা ষড়যন্ত্র করছে, তারা জানতে পারবে।’’
হাসপাতাল থেকে বার করে গাড়িতে ওঠানো পর্যন্ত সংবাদমাধ্যম পার্থকে মাত্রই কয়েকটি প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিল। তখনই তাঁকে ষড়যন্ত্র নিয়ে প্রশ্নের পাশাপাশিই জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, দল যে তাঁকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা কি ঠিক? জবাবে মুখ থেকে মাস্ক নামিয়ে পার্থ সরাসরিই বলেন, ‘‘দলের সিদ্ধান্ত দেখে নিন। সময়টা ঠিক না। নিরপেক্ষ তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে।’’ তাঁকে আবার প্রশ্ন করা হয়, দলের সিদ্ধান্ত কি ঠিক? দ্বিতীয় বার ওই প্রশ্নের জবাবে অবশ্য তিনি বলেন, ‘‘সময় বলবে।’’ বস্তুত, তিনি বার তিনেক মাস্ক নামিয়ে ওই শেষ দু’টি শব্দের পুনরাবৃত্তি করেন।
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, গাড়িতে বসার পর তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত কি ঠিক? তার জবাবে পার্থ বলেন, ‘‘হ্যাঁ, ঠিক।’’
পার্থের জবাব থেকে স্পষ্ট, তিনি মমতার সিদ্ধান্ত এবং দলের সিদ্ধান্তকে পৃথক করে দেখছেন। অর্থাৎ, মমতা তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা ঠিক। কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহূত বৈঠকে দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি তাঁকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত যে সময়ে নিয়েছে, তা ঠিক নয়। এর ফলে নিরপেক্ষ তদন্ত ‘প্রভাবিত’ হতে পারে।
প্রসঙ্গত, পার্থ ‘ষড়যন্ত্র’-এর তত্ত্বের কথা বলার পর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী কৌশলে শাসক তৃণমূলের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘পার্থকে নিয়ে তৃণমূল দু’টো ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। পার্থের বিরুদ্ধে এই দুর্নীতির অভিযোগে খুশি হয়েছে অভিষেকের শিবির।’’ হাসপাতাল থেকে বেরনোর পথে পার্থ যা বলেছেন, তাতে বিরোধীরা অধীর-বর্ণিত ওই ‘বিভাজন’-এর তত্ত্বে আরও ‘উৎসাহিত’ হবে বলেই মনে করছে তৃণমূলের একাংশ। যদিও দলের বড় অংশ মনে করছে, এর ফলে বিরোধীদের কোনও রাজনৈতিক সুবিধা হবে না। বস্তুত, দলের মধ্যে এমন কোনও ‘শিবির বিভাজন’-এর কথা তৃণমূলের কোনও সূত্রেই কখনও মেনে নেওয়া হয়নি।
তবে প্রজন্মের ফারাকের বিষয়টি নেতারা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারেননি। ঘটনাচক্রে, গত ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে পার্থ নিজেই মমতার ভাষণ শুরুর আগে প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুই প্রজন্মকে মেলানোর কাজ করছেন।’’ তৃণমূল গঠনের সময় থেকেই পার্থ মূলত মমতার ‘আস্থাভাজন’। বরাবর তিনি মমতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তেই থেকেছেন। অভিষেক বয়সে এবং রাজনীতিতে তাঁর চেয়ে অনেকটাই জুনিয়র। পার্থের অভিজ্ঞতাকে ‘মান্যতা’ দিয়েই অভিষেক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হওয়ার পর পার্থের বাড়ি গিয়েছিলেন তাঁর আশীর্বাদ নিতে।
কিন্তু দু’জনের সম্পর্কে একটা ‘শৈত্য’ আসে গত পুরভোটের সময়। তখন দু’টি প্রার্থিতালিকা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে বিভাজন তৈরি হয়। দলের মহাসচিব পার্থের তালিকার সঙ্গে শুরু হয় প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা ‘আইপ্যাক’-এর দেওয়া তালিকার লড়াই। পার্থের তালিকার সঙ্গে সহমত ছিলেন দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। সেই নিয়ে একটা সময়ে বিবৃতির লড়়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন দলের প্রবীণ সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। দুই শিবির এবং দুই তালিকার টানাপড়েনে মধ্যস্থতা করতে নামতে হয়েছিল স্বয়ং মমতাকে। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি আয়ত্তে এলেও পার্থ তখন এমন কিছু মন্তব্য করেছিলেন, যা দলের সাংগঠনিক নেতৃত্ব ভাল ভাবে নেননি। বস্তুত, দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির প্রধান হিসেবে কুণালকে ডেকে পাঠিয়ে সতর্ক করেছিলেন পার্থ।
তার কয়েক মাস পরেই ঘটনার নাটকীয় পট পরিবর্তন হয়েছে। দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে পার্থ গ্রেফতার হয়েছেন। দলকেও গভীর অস্বস্তিতে ফেলেছেন। প্রথম দিকে মমতা তাঁর প্রতি ‘সহানুভূতিশীল’ থাকলেও ‘অ্যারেস্ট মেমো’-তে পার্থ তাঁর নাম এবং ফোন নম্বর উল্লেখ করায় অসন্তুষ্ট হন মমতা। কালক্রমে আরও কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হওয়ায় পার্থকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মুখ্যমন্ত্রী। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দলীয় স্তরেও পার্থের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
তার পরের দিনই পার্থের দুই সিদ্ধান্তে অনাস্থা এবং আস্থার বিষয়টি ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। অর্থাৎ, মমতার উপর পার্থ এখনও আস্থা রেখেছেন। কিন্তু তাঁকে সাসপেন্ড করার দলীয় সিদ্ধান্তে (যা নেওয়া হয়েছে অভিষেকের নেতৃত্বে) তিনি খুশি নন।
বৃহস্পতিবারই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে প্রথমে মন্ত্রিত্ব এবং তার পরে দলের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পদ খোয়ান পার্থ। মন্ত্রী হিসেবে চারটি দফতরের দায়িত্ব ছিল পার্থর হাতে। সেই চারটি দফতরেরই দায়িত্ব থেকে পার্থকে ‘অব্যাহতি’ দিয়ে দফতরগুলি নিজের হাতে নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
তার কয়েক ঘণ্টা পর দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বৈঠকে দলের সমস্ত পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় পার্থকে। পাশাপাশিই, তদন্ত শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তাঁকে দল থেকে সাসপেন্ড করে রাখার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক স্পষ্ট জানিয়ে দেন, পার্থকে নিজেকেই নিজেকে আইনের চোখে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে। অভিষেক আরও বলেন, পার্থের দোষ প্রমাণ হয়নি। কিন্তু ‘উদাহরণ’ তৈরি করার জন্যই ওই সিদ্ধান্ত। তাঁর কথায়, ‘‘সবাই যাতে বুঝতে পারে, দল যদি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো নেতাকে সরাতে পারে, তবে দলের যে কোনও পদে থাকা ব্যক্তিই দোষ করলে রেহাই পাবেন না!’’
শাসক তৃণমূলের মহাসচিব ছিলেন পার্থ। ছিলেন সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য, সর্বভারতীয় সহ সভাপত, দলের মুখপত্রের সম্পাদক এবং শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির চেয়ারম্যানও। ঘটনাচক্রে পার্থকে দলের সমস্ত পদ থেকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্তও নেয় সেই শৃঙ্খলারক্ষা কমিটিই। যার বৈঠক ডেকেছিলেন অভিষেক। যে সিদ্ধান্তের ‘সময়’, পার্থ মনে করছেন, নিরপেক্ষ তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy