Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

গড়িমসিতে গভীর জলে মমতার ৩৪ মহা-হাসপাতাল

রাজ্যে সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এখন মাত্র একটিই। এসএসকেএম। সেটাও ওই তকমা পেয়েছিল বাম জমানায়। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই জায়গায় একেবারে ৩৪টা সুপার স্পেশ্যালিটি বা মহা-হাসপাতাল গড়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বসেছেন। কলকাতায় নয়। জেলায় জেলায়। ক্ষমতায় আসার চার বছর পরে দেখা যাচ্ছে, তাঁর সেই সাধের প্রকল্প লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার মুখে!

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৫ ০৩:৫০
Share: Save:

রাজ্যে সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এখন মাত্র একটিই। এসএসকেএম। সেটাও ওই তকমা পেয়েছিল বাম জমানায়। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই জায়গায় একেবারে ৩৪টা সুপার স্পেশ্যালিটি বা মহা-হাসপাতাল গড়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বসেছেন। কলকাতায় নয়। জেলায় জেলায়। ক্ষমতায় আসার চার বছর পরে দেখা যাচ্ছে, তাঁর সেই সাধের প্রকল্প লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার মুখে!

লক্ষ্য ছিল, চলতি বছরের মধ্যে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়ন গ্র্যান্ট ফান্ড বা বিআরজিএফ-এর টাকায় ৩৪টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের কাজ শেষ করা হবে। তার মধ্যে ২৭টি হাসপাতাল সম্পূর্ণ করা হবে আগামী অগস্টের মধ্যে। কিন্তু তার মধ্যে কোনও হাসপাতালের কাজ মাত্র ৩০% শেষ হয়েছে। কোনওটার নির্মাণকাজ ৫০% বাকি।

অথচ অর্থের কোনও সমস্যা নেই। টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের। এবং সেই টাকা এসে পড়েই আছে। প্রকল্প রূপায়ণের ভার রাজ্য সরকারের। আর সেখানেই যত গড়িমসি।

কেন? ঠিক কাদের গাফিলতিতে প্রকল্প রূপায়ণে এত দেরি?

এই নিয়ে স্বাস্থ্য দফতর আর ঠিকাদারদের মধ্যে চাপান-উতোর তুঙ্গে। স্বাস্থ্য ভবনের খবর, ঠিকাদার সংস্থাগুলিই কাজে গড়িমসি করছে। স্বাস্থ্যকর্তাদের দাবি, ওই সব সংস্থা নির্মাণস্থান ঘুরে দেখে নির্মাণ প্রক্রিয়া ঠিক করতেই এক বছরের বেশি সময় নিয়েছে। তাই সেই সূচনা পর্বেই প্রকল্প পিছিয়ে গিয়েছে অনেকটা। ঠিকাদারদের দোষ দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না স্বাস্থ্য দফতর। তাঁদের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তও নাকি পাকা!

কী সাজা হবে তাঁদের?

‘‘কাজ সময়মতো শেষ না-করায় ঠিকাদার সংস্থাগুলিকে শাস্তি পেতে হবে। তাদের জরিমানা করা হবে,’’ পরিষ্কার বলে দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী স্বয়ং।

স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য এবং শাস্তির সিদ্ধান্তে ঠিকাদার সংস্থার কর্তারা বেজায় চটেছেন। তাঁদের অভিযোগ, গোড়ায় গড়িমসিটা করেছে তো রাজ্য সরকারই। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরেই বিআরজিএফের প্রকল্প ঘোষিত হয়। কেন্দ্র সব রাজ্যকেই বলেছিল, তারা কোন কোন প্রকল্পে ওই টাকা খরচ করতে চায়, তা জানাক। মমতা তখন পশ্চিমবঙ্গে ৩৪টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব পাঠান। তা গৃহীত হয়। টাকাও মঞ্জুর হয়ে যায়। কিন্তু ২০১৩ সালের শেষ পর্যন্ত রাজ্য সরকার হাসপাতাল তৈরির প্রাথমিক কাজটাও শুরু করতে পারেনি বলে ঠিকাদারদের অভিযোগ।

স্বাস্থ্য অধিকর্তা যতই ঠিকাদারদের ঘাড়ে দোষ চাপান, তাঁর দফতরেরই একাংশ স্বীকার করে নিচ্ছেন সরকারি কর্তাদের দোলাচলের কথা। স্বাস্থ্য দফতরের ওই অংশ বলছেন, আসলে কর্তারাই বুঝতে পারছিলেন না, কী ভাবে কাজ হবে। তাঁরা পূর্ত দফতরকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু পূর্ত দফতর কিছু দিন পরে হাত গুটিয়ে নেয় এবং দরপত্র ডেকে ঠিকাদার সংস্থার মাধ্যমে কাজ করার পরামর্শ দেয়।

বিআরজিএফের প্রস্তাবিত ৩৪টি হাসপাতালের মধ্যে ২১টিই তৈরি হচ্ছে ‘টার্ন-কি মেথড’-এ। অর্থাৎ মাটি পরীক্ষার পরে ‘বেসিক এস্টিমেট’ বা প্রাথমিক খরচ-খরচার হিসেব কষে তার ভিত্তিতে ঠিকাদার সংস্থাগুলির কাছ থেকে দরপত্র চাওয়া হয়। ঠিকাদারদের অভিযোগ, এই ‘এস্টিমেট’ করতে স্বাস্থ্য দফতরই অনেক দেরি করে ফেলেছে। অথচ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে মুখরক্ষার জন্য ওই দফতর ঠিকাদার সংস্থাকে কাঠগড়ায় তুলছে।

বিআরজিএফ হাসপাতালের জন্য ২০১৪-’১৫ অর্থবর্ষে কেন্দ্র থেকে ৪৮৫ কোটি টাকা ছাড়া হয়েছিল। তার মধ্যে রাজ্য ব্যয় করতে পেরেছে ৩০০ কোটি। ২০১৫-’১৬ আর্থিক বছরে ওই সব হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ হয় ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আবার এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সময়সীমাও শেষ হয়ে গিয়েছে। রাজ্য সরকার সেই মেয়াদের মধ্যে কাজ শেষ করতে না-পারায় জটিলতা বেড়েই গিয়েছে। কেননা কেন্দ্রের কাছ থেকে আর কোনও টাকা মিলবে না। তা হলে ওই সব হাসপাতালের নির্মাণকাজ শেষ হবে কী ভাবে? আদৌ হবে কি?

প্রকল্প শেষ করতে মরিয়া রাজ্য সরকার জানিয়েছে, আর যে-টাকা লাগবে, ১৪তম অর্থ কমিশনের বরাদ্দ থেকেই তার ব্যবস্থা করা হবে।

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ৩৪টি হাসপাতালের মধ্যে ২০টির নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে ওয়েস্টবেঙ্গল মেডিক্যাল সার্ভিস কর্পোরেশন লিমিটেড বা ডব্লিউবিএমএসসিএল। সাতটির নির্মাণের ভার রাজ্য আবাসন দফতরের। বাকি সাতটি হাসপাতাল নির্মাণের দায়িত্ব হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনার্সের। দরপত্র ডেকে নিযুক্ত ঠিকাদার সংস্থাগুলি কাজ করছে এই তিন মূল সংস্থার অধীনে। অর্থাৎ তিন মূল সংস্থা দেরির দায় এড়াতে পারে না। কী বলছে ওই তিন সংস্থা?

ডব্লিউবিএমএসসিএল-এর এক কর্তা বলেন, ‘‘দেরি হয়েছেই। তার কারণ, কোথাও জমিতে গাছ কাটা নিয়ে সমস্যা হয়েছে। কোথাও বা জমির মাঝখানে ড্রেন বা রাস্তা পড়ে যাওয়ায় সমাধানসূত্র বার করতে সময় লেগেছে। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা, গড়িমসিও দায়ী। সে-ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য দফতর যদি ঠিকাদার সংস্থাগুলির জরিমানা করে, সেটা মানতে হবে।’’ আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। আর এইচআরবিসি-র ভাইস চেয়ারম্যান সাধনরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাদের বক্তব্য স্বাস্থ্য দফতরকে লিখিত ভাবে জানিয়েছি। তার বাইরে আর কিছু বলার নেই।’’

দায় এড়ানোর খেলায় জরিমানার হুমকি নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না বিরোধীরা। প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ব্যঙ্গের সুরে বলেছেন, ‘‘ওরা (শাসক দল) তো নিজেরাই ঠিকাদারদের স্বার্থরক্ষার পার্টি। ঠিকাদারদের চালায়। ওরা আবার ঠিকাদারদের দেরির জন্য জরিমানা করবে? তা হলেই হয়েছে!’’

আর কংগ্রেসের চিকিৎসক-বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার মন্তব্য, অবাস্তব পরিকল্পনা করে সাময়িক বাহবা পাওয়া যায়। কিন্তু তা রূপায়ণ করতে না-পারলে লোক-হাসানো হয়। চিকিৎসক হিসেবে মানসবাবুর বক্তব্য, ৩৪টি হাসপাতালে সব ধরনের ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ চিকিৎসার বদলে এক-একটি হাসপাতালে এক-এক ধরনের ‘স্পেশ্যালিটি’ চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে তবু হত। তিনি বলেন, ‘‘২০১১ থেকে এ-পর্যন্ত কোনও কোনও হাসপাতালে ইটই পড়েনি। এর পরে ডাক্তার, টেকনিশিয়ান নিয়োগ করতে হবে। এ বছর কেন, কত বছরে যে তা হবে, কে জানে!’’

কলকাতা-সহ সারা রাজ্যে এখনই যে-সব মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে, সেখানে শিক্ষক-ডাক্তার থেকে পরিকাঠামো— সব কিছুরই অভাব। এই অবস্থায় ৩৪ মহা-হাসপাতাল গড়ার ঘোষণা এবং কেন্দ্রের টাকা আসা সত্ত্বেও সেই সিদ্ধান্ত রূপায়ণে দেরির বিষয়টি বিরোধীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। সিপিএমের সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসও আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিষয়টিকে প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার করতে চাইছে। কারণ, মমতা এবং তাঁর সরকারের একাধিক মন্ত্রী গত বছর লোকসভা নির্বাচনেও ওই সব সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের কথা ফলাও করে প্রচার করেছেন। সেগুলো সময়মতো চালু করতে না-পারলে সেটাকে সরকারের বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখিয়ে প্রচার চালাতে কোমর বাঁধছেন বিরোধীরা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE