সম্মান: সন্তোষ রাণার হাতে পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। আনন্দ পুরস্কার ১৪২৪ অনুষ্ঠানে।
জলের কি রং থাকে? গোল টেবিলের উপর দুটি জলের বোতল ও গ্লাস। সেই টেবিলের এক দিকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান। অন্য দিকে প্রাক্তন রাষ্ট্রদ্রোহী। অতঃপর ‘রাজনীতির এক জীবন’ গ্রন্থের লেখক, একদা নকশাল নেতা সন্তোষ রাণার হাতে আনন্দ-সম্মান তুলে দিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। এক কথায় এটাই হতে পারত ৬১তম আনন্দ পুরস্কার-সন্ধ্যার ছায়ারেখা।
হতে পারত, কিন্তু হল না। কারণ দুই মেরুর দুই রাজনীতিকের বক্তব্যে বারংবার একটাই শব্দ ঘুরেফিরে এল। গণতন্ত্র! পুরস্কার প্রাপকের অভিভাষণে সন্তোষবাবু জানালেন, ‘পুরনো সমাজটাকে পাল্টে গণতন্ত্রকে আরও প্রসারিত করার জন্য, সমাজের সবাইকে সেই গণতন্ত্রের অংশীদার করে তোলার জন্য মানুষের সংগ্রাম আমার লেখার প্রেরণা।’ আর অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রণববাবু বললেন, ‘‘সন্তোষবাবু এই বইয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। আমাদের দেশেই আদিবাসীরা যে গণতন্ত্র অনুশীলন করে আসছেন, সেখান থেকে শিক্ষা নিই না কেন?’’
প্রণববাবু বলে চলেন, আদিবাসী সমাজে যে পঞ্চায়েত বসত, সেখানে গ্রামের সবাই যোগ দিত। সবাই একমত হলে তবেই সেই মতকে মেনে নেওয়া হত। আলোচনা হত যতক্ষণ না সকলে একমত হয়, কখনও বা সে আলোচনা দু’দিন-তিন দিন ধরে চলত। সবাই একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলে সভাপতি সেটাকেই সভার রায় বলে ঘোষণা করতেন। মানে, সংখ্যাগুরুর মত সেখানে কখনওই সংখ্যালঘু মতটিকে দমনের চেষ্টা করে স্বৈরতন্ত্র ও অসহিষ্ণুতার পরিবেশ সৃষ্টি করে না। প্রত্যেকেরই থাকে কথা বলার অধিকার। প্রণববাবু মনে করালেন, ১৯৫২ থেকে ২০১৪ অবধি ১৬টি লোকসভা নির্বাচনে কোনও দলই ৫১ শতাংশ ভোট পায়নি। ‘সংখ্যালঘু মত’ই রাজ্যশাসন নিয়ন্ত্রণ করেছে। সেখানেই সহিষ্ণুতার বিশেষ মূল্য।
ত্রয়ী: আনন্দ পুরস্কারের সন্ধ্যায় আড্ডায় মাতলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, প্রণব মুখোপাধ্যায় ও শঙ্খ ঘোষ। শনিবার।
জল যেমন আমাদের শরীরে বেঁচে থাকার অন্যতম শর্ত, পরমতসহিষ্ণুতা এবং গণতন্ত্রও কি রাষ্ট্রনৈতিক জীবনে সে রকম? পাঁচতারা হোটেলে শনিবার সন্ধ্যায় এখান থেকেই নীরবে উড়ান দিল এক মহাজিজ্ঞাসা। সাহিত্যরজনী ছাপিয়ে সে যাত্রা করল গণতন্ত্রের স্বরূপ সন্ধানে।
প্রণববাবু বলছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক জীবন প্রায় সন্তোষবাবুর রাজনৈতিক জীবনের সমান বয়সি। দু’জনের পথ আলাদা। কিন্তু সন্তোষবাবুর পথে এখনও কিছু কিছু মানুষ বিশ্বাস রাখেন। পথ আলাদা, কিন্তু লক্ষ্য তো এক— গণতন্ত্রের বিস্তার! তার একটু আগে উচ্চারিত হয়েছে সন্তোষবাবুর উদ্দেশে মানপত্রের কথাগুলি: বিপ্লব এবং গণতন্ত্রের মধ্যে এক গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। গণতান্ত্রিক বোধই তো সন্তোষবাবুকে বিপ্লবের কথা বলতে বাধ্য করেছে।
পুরস্কৃত আত্মজীবনীতে একটি ঘটনা আছে। বিপ্লবের দিনগুলিতে বন্দি নকশাল নেতাকে বিচারক জিজ্ঞেস করছেন, ‘আপনি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করার ডাক দিয়েছেন?’ রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ফলিত পদার্থবিদ্যার তরুণ গবেষক জানালেন, ‘আমি কোনও হিংসাত্মক কার্যকলাপ করিনি। সমাজ পাল্টানোর জন্য সশস্ত্র সংগ্রামও একটা পন্থা, সেটা বলেছিলাম। সেটা আমার মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে।’ সে দিনও সংবিধান-স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের কথাই বলছেন তিনি।
আত্মজীবনীতে যে ভাবে রাখঢাক না করে, অকপটে সব বলেছেন সন্তোষবাবু, এ দিনের অনুষ্ঠানেও সে রকম। জানালেন, বছর দুয়েক আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর বন্ধুবান্ধবদের অনুরোধে এই লেখা। বলছিলেন, ‘‘আর পাঁচটা অসুখের মতো ক্যানসারও এক শারীরবৃত্তীয় বিশৃঙ্খলা। সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে মনের জোর দরকার।’’ তার পরই যোগ করলেন, ‘‘দেশ এখন যে বিধ্বংসী বিশৃঙ্খলার মধ্য গিয়ে যাচ্ছে, সেখানেও একই কথা— মনের জোর ধরে রাখা।’’
গণতন্ত্রও তো এ দেশে ওই রকম মানসিক স্থৈর্য নিয়েই এগিয়েছে। রাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রধান এবং রাষ্ট্রের প্রতিস্পর্ধী শুধু হাল আমলের গণতান্ত্রিক বিপন্নতার কথাই বলেননি। সন্তোষবাবুর বইয়ে আছে, সুবর্ণরেখার ধারে তিলি-বাগদি অধ্যুষিত গ্রামটিতে তাঁদের হেটে বা গরুর গাড়িতে যাতায়াত করতে হত। প্রথম রেলগাড়ি দেখেছেন ঝাড়গ্রামে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিতে এসে। আর প্রণববাবু জানালেন, বীরভূমে তাঁদের গ্রামও রেললাইনের দশ কিলোমিটার দূরে। বর্ষায় গামছা পরে আর একটা গামছায় বই বেঁধে সাঁতরে স্কুলে যেতে হত। সেই অতীত পিছনে ফেলে দুই গ্রামই এগিয়েছে।
গণতন্ত্র এ ভাবেই এগিয়ে চলে। মানসিক স্থৈর্যে, পরমতসহিষ্ণুতায়। কোনও সর্বাধিনায়ক বা সর্বাধিনায়িকার রণহুঙ্কারে নয়।
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy