— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
আরজি করে খুন ও ধর্ষণ মামলার দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে কড়া নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ। মঙ্গলবার বিকেল ৫টার মধ্যে কাজে যোগ দিতে হবে তাঁদের। প্রধান বিচারপতি সোমবার শুনানি পর্বে এ-ও মন্তব্য করেছেন যে ওই ডাক্তারেরা কাজে যোগ না দিলে, তাঁদের বিরুদ্ধে রাজ্য কোনও পদক্ষেপ করলে শীর্ষ আদালত বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু কেন এই নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট? শীর্ষ আদালতের নির্দেশনামায় তার কিছুটা আভাস রয়েছে।
নির্দেশনামায় উল্লেখ করা হয়েছে, সোমবার আদালতে শুনানির সময় রাজ্য জানিয়েছে, বাংলায় মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলিতে ২৮ দিন ধরে রেসিডেন্ট ডাক্তারেরা গণছুটিতে রয়েছেন। যে কারণে স্বাস্থ্যব্যবস্থা মারাত্মক ভাবে ভেঙে পড়তে বসেছে। পাশাপাশি রাজ্য সরকার একটি স্টেটাস রিপোর্টও জমা দিয়েছে শীর্ষ আদালতে। স্বাস্থ্য দফতরের জমা করা ওই স্টেটাস রিপোর্টে কী উল্লেখ ছিল, তার একটি অংশ নির্দেশনামায় তুলে ধরেছে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ।
স্টেটাস রিপোর্টে রাজ্য জানিয়েছে, ২৮ দিন ধরে রেসিডেন্ট ডাক্তারদের গণছুটির কারণে পরিষেবা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তো হচ্ছেই, এমনকি এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে। কারণ, সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে রেসিডেন্ট ডাক্তারেরাই হলেন স্বাস্থ্য পরিষেবার মেরুদণ্ড। স্বাস্থ্য দফতরের যুক্তি, লাগাতার কর্মবিরতির কারণে সাধারণ মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। এই বিষয়ে একটি পরিসংখ্যানও তুলে ধরেছে রাজ্য। স্টেটাস রিপোর্টে উল্লেখ, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৬ লাখেরও বেশি রোগী বহির্বিভাগে পরিষেবা পাননি। বহির্বিভাগে সাধারণ দিনগুলিতে যেখানে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ আসতেন, এখন তা প্রায় ৪০ হাজারে নেমে এসেছে। যে কারণে কার্ডিয়োলজি, অঙ্কোলজি, নিউরোলজি-সহ মেডিক্যাল কলেজগুলির অন্যান্য বিভাগে গরিব মানুষদের পরিষেবা পেতে সমস্যা হচ্ছে।
রাজ্য আরও জানিয়েছে, এ ছাড়া হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসার সুযোগ (ইনডোর পরিষেবা) থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষ। ৬ লাখ ৪২ হাজার মানুষ বিনামূল্যে ল্যাবরেটরি টেস্ট করাতে পারেননি। প্রায় দেড় হাজার রোগীর স্টেন্ট বসানো ও অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি পিছিয়ে গিয়েছে। প্রায় সাড়ে ৬ হাজার গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচার পিছিয়ে দিতে হয়েছে। এমনকি ক্যানসার আক্রান্তেরাও অনেক ক্ষেত্রে ঠিকঠাক পরিষেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ এসেছে স্বাস্থ্য দফতরের কাছে। স্টেটাস রিপোর্টে রাজ্য জানিয়েছে, চিকিৎসা না পেয়ে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে তারা জানতে পেরেছে। যদিও সোমবার শুনানির সময় রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিব্বল জানিয়েছিলেন, মৃতের সংখ্যা ২৩।
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে জমা দেওয়া স্টেটাস রিপোর্টে রাজ্যের বক্তব্য, এই প্রতিবাদের আবহে রাজ্য সরকার একাধিক বার আন্দোলনরত চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে। বার বার তাঁদের অনুরোধ করেছে, কাজে যোগ দেওয়ার জন্য। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে রাজ্য সব রকম পদক্ষেপ করবে, সেই বার্তাও দেওয়া হয়েছে। কোন কোন দিনে, কোন পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে— সেই হিসাবও স্টেটাস রিপোর্টে উল্লেখ করেছে স্বাস্থ্য দফতর।
সেখানে বলা হয়েছে, ২১ অগস্ট স্বাস্থ্য ভবনের বৈঠকের কথা। সেই দিন আন্দোলনরত ডাক্তারদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান সচিব। ওই বৈঠকে আন্দোলনকারীদের সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে রাজ্য। মূলত চারটি দাবি ছিল সেখানে— অধ্যক্ষ, সুপার, বক্ষরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং ডিনকে বদল করতে হবে। সচিব নিজে আরজি করে গিয়ে আন্দোলনকারীদের জানিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে এবং তাঁদের কাজে ফেরার অনুরোধ করেছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের প্রথম দিনের নির্দেশনামার পর, ২৩ অগস্ট পুনরায় স্বাস্থ্যসচিব চিকিৎসকদের অনুরোধ করেছিলেন গরিব রোগীদের কথা বিবেচনা করে তাঁরা যেন কাজে ফেরেন। ২৪ অগস্ট মেডিক্যাল এডুকেশনের ডিরেক্টর আরজি করের আন্দোলনরত চিকিৎসকদের অনুরোধ করেছিলেন। আশ্বস্ত করেছিলেন, তাঁদের ক্ষোভ ও অভিযোগের কথা শোনা হবে। সেই দিনেই জয়েন্ট ডক্টর’স ফোরামের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের কাজে ফেরার অনুরোধ করেছিলেন স্বাস্থ্যসচিব।
যদিও রাজ্যের দেওয়া স্টেটাস রিপোর্টের প্রেক্ষিতে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন অর্ণব তরফদার বলেন, “স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে বলে যে পরিসংখ্যান রাজ্য সরকার দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে, তা একদমই মিথ্যা। কারণ, জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি করছেন। রাজ্যে মেডিক্যাল কলেজ কতগুলি আছে? মাত্র ২৬টি। বাকি রাজ্য জুড়ে প্রচুর হাসপাতাল, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল ও ব্লক হাসপাতাল রয়েছে। সেগুলিতে কী হচ্ছে? সেখানে তো পরিষেবা বন্ধ হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া মেডিক্যাল কলেজগুলিতেও কর্মবিরতি করছেন শুধু জুনিয়র ডাক্তারেরা। সিনিয়র ডাক্তারেরা পরিষেবা দিচ্ছেন।”
তিনি আরও বলেন, “জুনিয়র ডাক্তারদের পরিষেবা দেওয়ার কথা নয়। কারণ, আমরা শিক্ষানবিশ। ফলে পরিষেবা বিঘ্নিত হওয়ার কথা নয়। যদি ধরেও নিই পরিষেবা বিঘ্নিত হয়েছে, তা হলে তো ভেবে দেখতে হবে। তা হলে কি পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটাই জুনিয়র ডাক্তারদের দিয়ে চলে? বাস্তব চিত্রটা, অনেক জায়গাতে এটাই। জুনিয়র ডাক্তারদের ভরসাতেই চলে। কোনও সিনিয়র ডাক্তার নিয়োগ হয় না। বহু পদ বছরের পর বছর ফাঁকা রয়েছে। সরকার যদি সত্যি সত্যিই মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, তা হলে সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নত করুন এবং চিকিৎসক নিয়োগ করুন।”
বক্ষ রোগ বিভাগের সিনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তার শুভেন্দু মল্লিকের কথায়, “রাজ্যের এই বক্তব্যে আমরা ভীষণ হতাশ। শুধু তো জুনিয়র ডাক্তারেরাই কর্মবিরতিতে আছেন। এঁরা তো চিকিৎসা ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ হতে পারেন না। সিনিয়র ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা ডিউটি করছেন। শুধু জুনিয়র ডাক্তারদের জন্যই রোগী মারা যাচ্ছেন, এই তত্ত্বের আমরা বিরোধিতা করছি।” বরং, জেলা স্তরে হাসপাতালে পরিকাঠামোর অভাবের কথাই মনে করিয়ে দিলেন তিনি। তাঁর দাবি, সম্প্রতি সামান্য সিটি স্ক্যান করানোর জন্যও জেলা হাসপাতাল থেকে কোন্নগড়ের এক রোগীকে পাঠানো হয়েছে কলকাতায়।
প্রসঙ্গত, সোমবার মামলার শুনানির সময় আন্দোলনরত চিকিৎসকদের তরফের আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ জানান, ডাক্তারদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করছে রাজ্য সরকার। তাঁদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও আদালতে জানান আইনজীবী। এমনকি আন্দোলনরত চিকিৎসকদের পরিবারের যাঁরা সরকারি চাকরি করেন, তাঁদেরও বদলি করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
রাজ্যের দেওয়া স্টেটাস রিপোর্ট সোমবারই খতিয়ে দেখেছে শীর্ষ আদালত। শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছেন, “বাস্তব পরিস্থিতি কী চলেছে আমরা সবাই জানি। কিন্তু ডাক্তারদের কাজে ফিরতে হবে।” যাঁরা কাজে যোগ দেবেন, তাঁদের বদলি বা অন্য কোনও কড়া পদক্ষেপ করা চলবে না, সে কথাও রাজ্যকে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। এর পরই ডাক্তারদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, “চিকিৎসকদের প্রধান কাজ চিকিৎসা করা। তাঁদের নিরাপত্তার নির্দেশ আমরা দিয়েছি। তাঁরা কাজে যোগ না দিলে আমরা প্রত্যেককে নোটিস দেব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy