ছবি: পিটিআই।
রাজনৈতিক কর্মসূচি যেমন প্রতিবাদের অস্ত্র, তেমনই সংগঠনকে চাঙ্গা করার টনিকও বটে। বুধবারের বাংলা বন্ধে সেই দুই লক্ষ্যের কোনটায় কতটা ছাপ ফেলতে পারল আন্দোলন থেকে দূরে চলে যাওয়া রাজ্য বিজেপি?
দলের একাংশের মতে, বুধবারের বন্ধ কর্মীদের চাঙ্গা করেছে। তাদের রাস্তায় নামিয়েছে। জায়গায় জায়গায় ‘শক্তিপ্রদর্শন’ করা গিয়েছে। পাশাপাশিই, রাতারাতি এই বন্ধ সংগঠিত করতে গিয়ে যে ফাঁকফোকরগুলি ধরা পড়েছে, সেগুলি মেরামত করে পরের আন্দোলনে নামার সুযোগও তৈরি হয়েছে। আবার অন্য অংশের বক্তব্য, নেতারা অনুগামীদের নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন ঠিকই। কিন্তু দলের সাধারণ কর্মীদের তেমন ভাবে দেখা পাওয়া গেল কি? কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় প্রথম সারির নেতা-নেত্রীরা মিছিল করলেন, নামমাত্র অবরোধে শামিল হলেন। ছবি উঠল। তার পরে তাঁরা পটাপট পুলিশের গাড়িতে উঠে পড়লেন। এক রাজ্য নেতার অবশ্য বক্তব্য, ‘‘কমপক্ষে এটুকু তো হয়েছে। শুধুই বৈঠক-করা নেতারা পথে নেমেছেন। অনেক দিন পর পুলিশের গাড়িতে উঠেছেন। ঐক্যের ছবিও দেখা গিয়েছে।’’
বস্তুত, সে অর্থে দেখতে গেলে কিছু এলাকাভিত্তিক জোরজুলুম এবং রেল অবরোধ ছাড়া মোটের উপর বন্ধ ব্যর্থই। কলকাতা শহর সকাল থেকেই স্বাভাবিক ছিল। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বাভাবিকতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সে অর্থে বন্ধের কোনও ‘ছাপ’ বা ‘প্রভাব’ কোথাও পড়েনি।
মূলত ‘সমাজমাধ্যমে উপস্থিতি’ থেকে খানিকটা হলেও বেরিয়ে এসেছে সিপিএম। যদিও তাদের রাজনৈতিক উপস্থিতি এখনও বলার মতো নয়। রাজ্যে দলের কোনও জনপ্রতিনিধিও নেই। কংগ্রেসের অবস্থাও তথৈবচ। কিন্তু রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে বিজেপিও কার্যত গর্তে ঢুকে গিয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর। রাজ্য বিজেপির নেতারা শুধু ‘ভার্চুয়াল’ বৈঠক আর ‘এক্স’ (পূর্বতন টুইটার) হ্যান্ডল ব্যবহারকারী হয়ে গিয়েছেন বলে দলের মধ্যেই সমালোচনা ছিল। গত বিধানসভা নির্বাচনের পরেও বিজেপি ‘ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস’ নিয়ে যতটা রাজনীতি করেছিল, ততটাও পারেনি লোকসভা ভোটের পর। রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার কেন্দ্রের প্রতিমন্ত্রী হয়ে যাওয়ার পরে বিজেপি কার্যত ‘অনাথ’ হয়ে যায়। সভাপতি বদল হবে ধরে নিয়ে সুকান্ত যেমন দিল্লিতে বেশি সময় দিতে শুরু করেন, তেমনই কে পরবর্তী সভাপতি, তা নিয়েই দু’মাস কাটিয়ে দেয় বিজেপি। শুধু বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তাঁর মতো করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে আরজি কর-কাণ্ড বিজেপিকে সংগঠনের মরা গাঙে বান আনার সুযোগ করে দিয়েছে বলেই মনে করেছেন রাজ্য নেতৃত্ব। সে কারণেই ‘ছাত্র সমাজ’-এর ডাকে মঙ্গল-অভিযানের পর বাংলা বন্ধ ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য বিজেপি। যতটা না প্রতিবাদ, তার চেয়ে বেশি লক্ষ্য ছিল নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি যাচাই করে নেওয়া। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে বুধবার বিজেপি স্পষ্ট বার্তা পেয়েছে যে, নিচু স্তরের কর্মীরা এখনও সে ভাবে বাড়ির বাইরে বেরোতে তৈরি নন। সংগঠনের ভিত যে স্থবির হয়ে রয়েছে তা-ও টের পেয়েছেন রাজ্য নেতারা। যদিও রাজ্য সভাপতি হিসাবে সুকান্তের দাবি, ‘‘বুধবারের বন্ধে আমাদের সব নেতা, সাংসদ, বিধায়ক নেমেছেন। কর্মীরাও নেমেছেন। পুলিশ আর তৃণমূলের যৌথ বাধা, ভয় দেখানো না থাকলে বন্ধ আরও সফল হত।’’
কিন্তু সত্যিই কি বিজেপির কোনও লাভ হয়েছে এই বন্ধ ডেকে? সুকান্ত বলেন, ‘‘লাভের জন্য আমরা বন্ধ ডাকিনি। আমরা প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছিলাম। রাজ্যের মানুষ যে আমাদের সঙ্গে, সেটা বোঝা গিয়েছে। অনেক জায়গাতেই মানুষ বাড়ি থেকে না বেরিয়ে আমাদের নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন। জোর করে ট্রেন, গাড়ি চালানো হলেও যাত্রী প্রায় ছিলই না।’’
সুকান্ত এমন দাবি করলেও দলের অনেকেই কিন্তু তা মানছেন না। আরজি কর নিয়ে সাধারণের মধ্যে যে ক্ষোভ দেখা গেলেও বন্ধ তাতে নতুন মাত্রা আনতে পারেনি বলে পদ্মশিবিরেই আলোচনা রয়েছে। বরং ভোগান্তির জন্য এবং মূল ‘নির্যাতিতার বিচার চাই’ দাবি থেকে আন্দোলন শাসক বনাম বিরোধী করে দেওয়ার চেষ্টাই বেশি ধরা পড়েছে। এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘আমরা বন্ধ ডেকেছি। রাস্তায় নেমেছি। কিন্তু রাজ্যের মানুষ মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদ করলেও বন্ধ চান কি না, সেটা যাচাই করিনি। তাই এখনই লাভ-লোকসানের হিসাব কষা ঠিক হবে না।’’
লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পরেও রাজ্য বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাংলায় সংগঠনে জোর দেওয়ার বিষয়ে নজর দেননি বলে রাজ্য বিজেপির অন্দরে আগে থেকেই অনুযোগ ছিল। সেই সমালোচকেরাও বুধবারের বন্ধ নিয়ে একই কথা বলছেন। ওই মতের শরিক এক নেতা বলেন, ‘‘মঙ্গলবারের নবান্ন অভিযানে গোলমাল হবে ধরে নিয়ে অনেক আগে থেকেই বন্ধ ডাকার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা যেত। গোটা রাজ্যে যাতে কর্মীরা সংগঠিত ভাবে রাস্তায় নামেন, সে চেষ্টাও করা যেত। পরিকল্পনার অভাবে বন্ধ ডেকেও দল সে ভাবে সুবিধা পেল না।’’
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার বিকেলে বন্ধ ডাকেন সুকান্ত। এক রাতের মধ্যে কর্মীদের রাস্তায় নামানো যাবে কি না সে প্রশ্ন উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গেই। কেউ কেউ চেয়েছিলেন বন্ধ ডাকা হোক শুক্রবার। কিন্তু দলেরই আর এক অংশ বলেন, উত্তাপ থাকতে থাকতেই লোহায় ঘা মারা দরকার। সেই অংশের যুক্তিতেই বুধবারের বন্ধ। ভাবনা ছিল, দলের শক্তি ব্যবহার না করা গেলেও সার্বিক ক্ষোভের আবহে বন্ধ সফল করা যাবে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজ্য বিজেপি দফতরে বৈঠকের পরে পুরুলিয়ার সাংসদ জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো, রানাঘাটের জগন্নাথ সরকারেরা নিজের নিজের এলাকায় ফিরে যান। এর পরে খুবই কম সমর্থককে সঙ্গে নিয়ে এক-আধটি জায়গায় বিক্ষোভ দেখিয়ে পুলিশের হাতে ধরা দেন। কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনসলের ‘লোক দেখানো আন্দোলন নয়’ ধমকের পরেই অবশ্য সব নেতা এক সারিতে। যদিও বুধবারের বন্ধে কোথাও দেখা যায়নি প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে। প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার নবান্ন অভিযানের দিনেও দিলীপকে ধারেপাশে দেখা যায়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy