গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আরজি কর-কাণ্ডে তৈরি হওয়া গণক্ষোভের আবহে আমজনতার নাড়ির স্পন্দন ছুঁলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) প্রতিষ্ঠা দিবসের সভা থেকে অভিষেক যেমন প্রশ্ন তুলেছেন, কেন সন্দীপ ঘোষকে এখনও সিবিআই গ্রেফতার করছে না, তেমনই সরাসরি গত ১৪ অগস্ট রাতে মহিলাদের রাত দখল কর্মসূচিকে ‘সম্মান’ জানিয়েছেন। যা থেকে স্পষ্ট যে, আরজি কর-কাণ্ডে স্বাস্থ্যমহল এবং সাধারণ বঙ্গবাসীর যে দাবি, সেই সুরেই কথা বলেছেন তৃণমূলের সেনাপতি।
আরজি কর-কাণ্ডের পর বুধবার ছিল তৃণমূলের সবচেয়ে বড় জমায়েত। সে অর্থে অভিষেকেরও প্রথম সরাসরি ‘বার্তা’ দেওয়ার অবকাশ। ওই ঘটনার পরে পরেই আমতলায় নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রের প্রশাসনিক বৈঠকের পর মুখ খুলেছিলেন অভিষেক। যেখানে তিনি ধর্ষণের মতো অপরাধের জন্য কঠোরতম আইন আনা এবং চূড়ান্ত শাস্তির পক্ষে দাবি জানিয়েছিলেন। সেই থেকেই ধারাবাহিক ভাবে তিনি ওই আইন প্রণয়ন নিয়ে সমাজমাধ্যমে নিজের বক্তব্য জানিয়ে যাচ্ছেন। বুধবারের সভা থেকেও প্রকাশ্যে তিনি আরও এক বার সেই দাবি তুলেছেন। পাশাপাশিই, কড়া আক্রমণ করেছেন সিবিআইকেও। দ্বিতীয়টি শাসকদলের অন্যতম নেতা হিসাবে তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশিতই। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ এবং ‘অর্থবহ’ তাঁর বলা বাকি দু’টি বক্তব্য।
সংক্ষিপ্ত ভাষণে অভিষেক সরাসরিই বলেছেন, ‘‘আমি মহিলাদের রাত দখলকে সম্মান জানাই। সে দিন দাবি ছিল দু’টি। এক, ধর্ষণমুক্ত সমাজ এবং দুই, দোষীদের শাস্তি।’’ এর পরেই আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপের প্রসঙ্গের অবতারণা করেন অভিষেক। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতা পুলিশের হাতে চার দিন তদন্তভার ছিল। আজকে ১৪ দিন হয়ে গেল সিবিআই তদন্ত করছে। কেন এই ১৪ দিনেও সন্দীপ ঘোষ অ্যারেস্ট (গ্রেফতার) হলেন না, তার জবাব সিবিআইকেই দিতে হবে।’’ মঞ্চে উপস্থিত তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘অভিষেক যে আচমকা সন্দীপ ঘোষের নাম বলে ওই কথা বলে দেবেন, তা আমরাও বুঝতে পারিনি। প্রথমে শুনে আমরাও হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম!’’ এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। কারণ, অভিষেকের সঙ্গে একই মঞ্চে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁর সরকারের নির্দেশে সন্দীপ আরজি করের অধ্যক্ষ পদে ইস্তফা দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যে তাঁকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পদে ‘পুনর্বাসন’ দেওয়া হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, ‘মেয়েদের রাত দখল’ কর্মসূচিকে প্রথম থেকেই প্রকাশ্যে ‘লঘু’ করে দেখাতে চেয়েছেন তৃণমূলের প্রায় সমস্ত নেতা। তার ‘অভিঘাত’ সম্পর্কে ভিতরে ভিতরে অবহিত থাকলেও তাঁরা বলে গিয়েছেন, সেটি ‘রাম-বামের কর্মসূচি’। যা আদপেই তা ছিল না। অভিষেকই তৃণমূলের প্রথম নেতা, যিনি সর্বসমক্ষে ওই কর্মসূচিকে ‘সম্মান’ জানালেন। যাতে বাইরে তো বটেই, দলের অভ্যন্তরেও বার্তা দিলেন তিনি। অভিষেকের স্তরের কোনও নেতা যদি এমন কথা সর্বসমক্ষে বলেন, তা হলে তার ‘গুরুত্ব’ ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে যায়। সেই বার্তা অন্য রকমের ‘তাৎপর্য’ বহন করে। যে বার্তা বলে, জনতার নাড়ির স্পন্দন বুঝতে হবে। জনমন বুঝতে হবে। অভিষেকের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এক নেতার কথায়, ‘‘সেনাপতির বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, তিনি সরকারের কোনও ভুল আড়াল করতে চাইছেন না। করবেনও না। দ্বিতীয়ত, তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, জনতার আন্দোলনের শরিক হতে হবে।’’ তৃণমূলের একটি বড় অংশের মতে, অভিষেক পরিকল্পিত ভাবেই ‘মেয়েদের রাত দখল’ এবং সন্দীপের প্রসঙ্গ পর পর উত্থাপন করেছেন। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘রাত দখলের কর্মসূচিতে আমাদের সক্রিয় কর্মীদের পরিবারের লোকজনও শামিল হয়েছেন। অভিষেক সেটাকেও মর্যাদা দিয়েছেন। পাশাপাশি, সন্দীপকে আড়াল করা হচ্ছে বলে রাজ্য সরকার তথা পার্টির উপর যে দায় চাপানো হচ্ছিল, সেটাকেও সিবিআইয়ের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছেন।’’
গত ১০ দিন ধরে সন্দীপ রোজ সকালে সিজিও কমপ্লেক্সে যান, রাতে বাড়ি ফেরেন, পরের দিন সকালে আবার যান। এই ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জনমানসেও প্রশ্ন রয়েছে। সমাজমাধ্যমে অনেকে সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। অভিষেক বুধবারের সভা থেকে সেটাকেই আরও উস্কে দিতে চেয়েছেন বলে অনেকের অভিমত।
আরজি কর-কাণ্ডের পর থেকেই অভিষেক ধর্ষণ-বিরোধী কঠোরতম আইনের পক্ষে সওয়াল করছেন। তিনি এমন আইন চান, যাতে ৫০ দিনের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে চরম শাস্তি সুনিশ্চিত হবে (বস্সুত, অভিষেক এমনও অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, এই ধরনের অপরাধীদের ‘এনকাউন্টার’ করে মেরে দেওয়া উচিত। এদের বাঁচিয়ে রাখলে সরকারের অর্থ অনর্থক ব্যয় হয়)। একই ভাবে সেই আইন যাতে ভয় পাওয়ানোর মতো হয়, তার পক্ষেও সওয়াল করেছেন তৃণমূলের সেনাপতি। গত ২২ অগস্ট এই মর্মে একটি পোস্টও করেছিলেন সমাজমাধ্যমে। সেই বক্তব্যকে প্রত্যক্ষ ভাবে সমর্থন জানিয়েছেন অন্তত তিন লক্ষ মানুষ। অভিষেক-ঘনিষ্ঠেরা হিসাব করে দাবি করেছেন, সব মিলিয়ে ১২ কোটির বেশি মানুষের কাছে অভিষেকের ওই বক্তব্য পৌঁছেছে। বুধবারের সভা থেকেও সেই কথা বলেছেন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ।
চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় যখন বঙ্গ রাজনীতি তপ্ত, বিজেপি, সিপিএমের মতো দলগুলি যখন বাংলাদেশ মডেলে স্লোগান দিচ্ছে, ‘দফা এক দাবি এক, মমতার পদত্যাগ’, তখন তাদের উদ্দেশেও পাল্টা বার্তা দিতে চেয়েছেন অভিষেক। তাঁর কথায়, ‘‘দফা এক, দাবি এক, ধর্ষণ-বিরোধী কড়া আইন।’’ তিনি বলেছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার যদি পদক্ষেপ না করে, তা হলে আমি সাংসদ হিসাবে প্রাইভেট মেম্বার বিল (ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিল) আনব লোকসভায়।’’ পদ্মশিবিরের উদ্দেশে অভিষেক ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র পরিসংখ্যান তুলে ধরে আক্রমণ শানিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘গত ১০ বছরে উত্তরপ্রদেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ৪১,৭৩৩টি, মধ্যপ্রদেশে ৩৬,১৪৪টি, রাজস্থানে প্রায় ২৮ হাজার এবং মহারাষ্ট্রে প্রায় ২৫ হাজার। উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, মধ্যপ্রদেশে মোহনলাল যাদব, রাজস্থানে ভজনলাল শর্মা এবং মহারাষ্ট্রে একনাথ শিন্ডে। সব ডবল ইঞ্জিন সরকার। আগে এই চার জনের পদত্যাগের দাবি করো! তার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে আঙুল তুলবে।’’
বুধবার অভিষেক তাঁর বক্তৃতায় বিচারের দাবিতে মানুষের আন্দোলনকে সমর্থন করে রাজনৈতিক ভাবেও জনতার ‘আস্থা’ অর্জন করতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে বিজেপি যে ভাবে ‘জঙ্গি মেজাজে’ রাস্তায় নেমেছে, তার বিরুদ্ধেও জনমত গড়ে তুলতে চেয়েছেন।
ধর্ষণ বিরোধী আইনের জন্য তৃণমূল দিল্লিতেও সরব হবে বলেও মেয়ো রোডের মঞ্চ থেকে জানিয়েছেন অভিষেক। তৃণমূলের সেনাপতি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘রাতারাতি নোটবন্দি হতে পারে, লকডাউন হতে পারে, অধ্যাদেশ জারি করে দিল্লি সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্র কুক্ষিগত করতে পারে। তা হলে কেন এই আইন দ্রুত আনা যাচ্ছে না?’’ বিজেপির উদ্দেশে কটাক্ষ ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বিজেপি আইন আনবে না। কারণ, এই আইন এলে পাতাখোর, মাতাল, চিটিংবাজ বিজেপির লোকেদেরই শাস্তি পেতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy