Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
BJP

শুধু বিপর্যয়ে রক্ষা নেই, অভিযোগ দোসর! ৫ ত্রুটি নিয়ে জেরবার বঙ্গ বিজেপি, অর্থ নিয়েও চলেছে অনর্থ?

নানা সমালোচনার মধ্যে পাঁচটি বিষয় কাঁটার মতো বিঁধছে পদ্মশিবিরের কর্তাদের। যদিও সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি ও উদ্বেগের বিষয় দলের নেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ।

West Bengal BJP faces 5 questions after Lok Sabha Election 2024

শুভেন্দু অধিকারী ও সুকান্ত মজুমদার। —ফাইল চিত্র।

পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪ ০৯:০০
Share: Save:

লক্ষ্য ছিল ৩০ পার করার। কিন্তু ১২ আসনে আটকে গিয়েছে বিজেপি। সেই বিপর্যয়ের ‘ধাক্কা’ কাটার আগেই দলের ভিতরে নানা প্রশ্নে জেরবার রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। সাংগঠনিক ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে, তেমনই অনেক নেতার আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়েও উঠছে নানা অভিযোগ। এবং কোথাও কোথাও কিছু আর্থিক ‘বিচ্যুতি’ যে হয়েছে, একান্ত আলোচনায় তা মানছেন রাজ্য নেতাদের অনেকে। তবে সেটা ‘বড়’ কিছু নয় বলেও দাবি। দলীয় স্তরে সে সব পর্যালোচনার মধ্যেই প্রকাশ্যে আসছে পরাজিত প্রার্থী এবং জেলা নেতাদের মধ্যে গন্ডগোলের কথা। নির্বাচনের সময়ে আড়াল থেকে বিজেপিকে সাহায্যকারী সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন সংগঠনের তরফেও নানা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। পদ্মশিবিরের অস্বস্তি কাটছে না। বিপর্যয়ের সঙ্গেই উড়ে আসছে সমালোচনা।

সে সব সমালোচনার মধ্যে পাঁচটি বিষয় কাঁটার মতো বিঁধছে পদ্মশিবিরের কর্তাদের। যদিও সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি ও উদ্বেগের বিষয় দলের নেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ। যদিও রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র তথা রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘পরিকল্পিত ভাবে একটা অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। সে অস্থিরতা থেকে দল শীঘ্রই বেরিয়ে আসবে। আমাদের দলে এ সব তছরুপ হয় না।’’

ত্রুটি ১:

সাংগঠনিক ত্রুটি। লোকসভা নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক সঙ্ঘনেতার বক্তব্য, ‘‘সাধারণ সংগঠন এবং ভোট রাজনীতির মধ্যে যে ফারাক রয়েছে, সেটা বুঝতে হবে। জেলা স্তরের বেশির ভাগ নেতা নির্বাচনের জন্য কখন কী কী করা প্রয়োজন, সেটাই জানেন না। অনেকেই রাজনীতিতে নতুন। তাঁদের অভিজ্ঞতাও নেই। বরং অন্য দল থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই বেশি অভিজ্ঞ।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘জেলা সভাপতিরাই অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচনী কৌশল বোঝেন না। তাঁরা ভাল মানুষ, ভাল বক্তা। কেউ কেউ ভাল সংগঠকও। কিন্তু নির্বাচনে জিততে হলে যা যা করতে হয়, সেটা জানা নেই।’’ আগামী দিনে দলের জেলা নেতাদের এই ধরনের কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার বলেও মনে করেন ওই নেতা।

ত্রুটি ২:

জেলা থেকে রাজ্যকে পাঠানো রিপোর্ট এবং রাজ্য যা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে পাঠায়, তা কতটা সঠিক? সারা বছর বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নানা কর্মসূচির নির্দেশ দেন। সেগুলি নাম-কা-ওয়াস্তে পালিত হলেও বেশি বেশি করে দেখিয়ে রিপোর্ট দেওয়া হয়। সেই ‘ভুল’ রিপোর্টের খেসারত নির্বাচনে দিতে হয়েছে। এক জেলা সভাপতির যেমন বক্তব্য, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠান শোনার কর্মসূচি বুথ স্তরে করার কথা। সর্বত্র তা হয় না। কিন্তু রিপোর্ট আসে, সব ঠিকঠাক হয়েছে। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য নেতৃত্ব এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে বলেন। কিন্তু সবটা করার মতো শক্তি যে আদৌ আমাদের নেই, সেটা মানতে হবে। তার বদলে ভুল রিপোর্টের আত্মতুষ্টি দলের সর্বনাশ করছে।’’

ত্রুটি ৩:

নির্বাচনের সময়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে ভিড় দেখা গিয়েছে। কিন্তু সর্বত্র সেই ভিড়ের মানুষগুলো এক ছিল। জেলার দুই জায়গায় দুই সভায় একই কর্মী-সমর্থকেরা গিয়েছেন। আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাতেও আশপাশের জেলা থেকে আসা একই মুখের ভিড় হয়েছে। দলের এক নেতার বক্তব্য, ‘‘আমরা নিজেরাই নিজেদের ঠকিয়েছি। ভিড় দেখে মনে হয়েছে জেলায় ভাল ফল হবে। কিন্তু হয়নি।’’ রাজ্য নেতাদের দুষে ওই জেলার নেতা আরও বলেন, ‘‘তাঁরাই আমাদের ওই ভাবে লোক জড়ো করতে বলেছেন। সারা বছর কর্মীর সংখ্যা বাড়ানোর কাজ ঠিকমতো না করে ভোটের সময়ে ভিড় বাড়ানোর ফাঁকিবাজি দলের ক্ষতি করেছে।’’ তাঁর উদাহরণ, কলকাতা উত্তরে মোদীর রোড-শো ‘সফল’ দেখাতে আশপাশের জেলা থেকে কর্মীদের নিয়ে গিয়ে ভিড় করা গেলেও ইভিএমে সেই ভিড়ের ছায়া পড়েনি।

ত্রুটি ৪:

লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে এটা স্পষ্ট যে, শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় বিজেপি কম ভোট পেয়েছে। রাজ্য বিজেপির কাছে চতুর্থ ত্রুটি গ্রামাঞ্চলের ভোট টানতে সে ভাবে সভা না করা। মোদী থেকে সুকান্ত-শুভেন্দুর সভা যে সব জায়গায় হয়েছে, সেগুলির বেশির ভাগই শহর এলাকায়। কিন্তু রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায় রাজ্য সরকারের ‘দুর্নীতি’ থেকে বাংলায় কর্মসংস্থানের অভাব, কেন ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে রাখা হয়েছে, তার প্রচার হয়নি। লক্ষ্মীর ভান্ডার নিয়ে তৃণমূলের প্রচারের পাল্টা কোনও বক্তব্য নিয়ে গ্রামীণ মহিলাদের কাছে যাওয়া হয়নি। প্রচার কোথাও কোথাও হলেও কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত বৈঠক হয়নি।

ত্রুটি ৫:

অনেক জেলা থেকে রাজ্যনেতৃত্বের বিরুদ্ধে আর্থিক নয়ছয়ের অভিযোগ। মূলত পরাজিত প্রার্থী এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠেরাই সেই অভিযোগ তুলছেন। বিজেপিতে সাধারণ ভাবে নির্বাচনী খরচের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখার পদ্ধতি রয়েছে। ব্যক্তিবিশেষ যাতে একক ভাবে খরচ করতে না পারেন, তার জন্য নিয়মের বজ্রআঁটুনিও রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ উঠছে যে, জেলা স্তরের কোনও কোনও নেতা দলবেঁধে ভোটের খরচ বাবদ পাওয়া টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ওই অভিযোগে প্রথম প্রকাশ্যে সরব হন কৃষ্ণনগরের প্রার্থী অমৃতা রায়। তাঁকে দিয়ে চেকবইয়ের অনেক পাতায় সই করিয়ে টাকা তোলা হলেও তিনি পরে হিসাব পাননি বলে দাবি করেন অমৃতা। তার পরে ডায়মন্ড হারবার থেকে বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম থেকে বসিরহাট— অনেক আসনেই এমন প্রশ্ন উঠেছে।

এই বিষয়টি নিয়ে দলের অন্দরেও আলোচনা শুরু হয়েছে। কী ভাবে খরচ হয় বিজেপির নির্বাচনী তহবিল? পদ্মশিবির সূত্রে জানা গিয়েছে, দলের তরফে যে অর্থ দেওয়া হয়, তার একটা অংশ যায় প্রার্থীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। যা দেওয়া হয়েছিল প্রার্থী মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরে। তার আগের খরচ প্রার্থী নিজের থেকে বা জেলার তহবিল থেকে করেন। তবে বসিরহাটের রেখা পাত্রের মতো প্রার্থীর ক্ষেত্রে সব খরচই দল করে। জেলা সভাপতি ও লোকসভা ইনচার্জ থাকেন দলীয় অ্যাকাউন্ট থেকে খরচের দায়িত্বে। বুথপিছু ২০ হাজার টাকার মতো দেওয়া হয় ভোটঘোষণার পরে পরেই। সাধারণ ভাবে একটি লোকসভা এলাকায় ১৯০০-র মতো বুথ থাকে। এই খাতেই খরচ হয় প্রায় চার কোটি টাকা। এর পরে পোস্টার-ব্যানার ছাপানোর খরচ হিসাবেও মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হয় জেলাকে। অন্য দিকে, প্রার্থীর কাছে যে টাকা যায়, তা তিনি খরচ করতে পারেন প্রচারে। কোন খরচ জেলা এবং প্রার্থী সামলাবেন সেটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করার কথা। রাজ্য বিজেপির পক্ষেও প্রচারসামগ্রী দেওয়া হয়। তবে সেটা সকলের জন্য একই ধরনের। বড় সভা বা সমাবেশের জন্য আলাদা করে জেলানেতৃত্ব টাকা পান। রাজ্যনেতার সভা আর প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশের মধ্যে অবশ্য ব্যয়ের তফাত আকাশ-পাতাল। ৫০ হাজার থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ হয় সভার আকার হিসাবে। তবে এই খরচের ব্যাপারে প্রার্থীর কোনও ভূমিকা থাকে না। পুরোটাই সরাসরি রাজ্য অথবা জেলানেতৃত্বের মাধ্যমে হয়। এর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবও রাখা হয়। তবে এর মধ্যে বিভিন্ন ছোট ছোট খরচের মধ্যে থেকে কেউ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন কি না, তা সব সময়ে ধরাও পড়ে না। তা মেনে নিয়েছেন অনেক রাজ্য নেতাই। তবে তার পরিমাণ ‘বিপুল’ নয় বলেই দাবি। রাজ্যস্তরের এক নেতার কথায়, ‘‘অন্য দলের তুলনায় আমাদের দলে চুরিচামারি অনেক কম। কারণ হিসাব রাখার পদ্ধতি খুব কড়া। আর দলের টাকা একার ইচ্ছায় খরচ করা যায় না।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘পরাজিতেরাই বেশি বেশি প্রশ্ন তোলেন এবং তুলছেন। হারের পরে তো সকলেই ‘ভিলেন’ খোঁজেন!’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy