গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
গঙ্গাসাগর মেলা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ক্রমবর্ধমান করোনা সংক্রমণের প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখল ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ওই কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘ওরা কাকুতিমিনতি করে চিঠি দিয়েছে। যাদের ভলান্টিয়ার করে পাঠায়, তাদের মধ্যে অনেকে কোভিডে আক্রান্ত। ফলে ওরা ভলান্টিয়ার পাঠাতে পারবে না।’’
গঙ্গাসাগর মেলা আয়োজন সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, ‘‘ওটা আদালতের বিচারাধীন। আদালত তাদের রায় দিক।’’ প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্ট ওই রায়দান স্থগিত রেখেছে। আদালত জানিয়েছে, কোনও ‘স্বাধীন’ সংগঠনকে দিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তবে শেষমেশ তা না-ও করতে পারে আদালত। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না।
সাগরমেলা শুরু আগামী ১০ জানুয়ারি। গঙ্গাসাগর মেলার সঙ্গে যুক্ত অন্যতম প্রধান ধর্মীয় সংগঠন হল ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। তাঁদের সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কতটা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে তা নিয়ে চিন্তিত সন্ন্যাসীরা। সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজ প্রথম থেকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশে থাকার পাশাপাশি তীর্থক্ষেত্র সংস্কারের কথা বলেছেন। তিনি নিজেও কাশী, গয়া, পুরীতে তীর্থযাত্রীদের সুবিধার জন্য নানা ভাবে উদ্যোগী হয়েছেন। একইসঙ্গে দেশের সর্বত্র ধর্মীয় মেলায় তাঁর সংগঠনকে আয়োজনের অংশ করেছেন।
সেই রীতি মেনে এই শতাব্দীপ্রাচীন সংগঠন ইলাহাবাদ, হরিদ্বার, উজ্জ্বয়িনী এবং নাসিকে কুম্ভমেলায় অন্যতম প্রধান ভূমিকা নেয়। একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গাসাগর মেলার ব্যবস্থাপনাতেও বড় ভূমিকা নেয় সঙ্ঘ। কিন্তু এ বার রাজ্যে যে হারে করোনা সংক্রমণ বেড়ে চলেছে, তাতে গঙ্গাসাগর মেলার আয়োজন নিয়ে প্রথম থেকেই দ্বিধায় ছিলেন সঙ্ঘের সন্ন্যাসীরা। কলকাতার বালিগঞ্জে সঙ্ঘের প্রধান কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, কী ভাবে সংক্রমণের শঙ্কার মধ্যে মেলার আয়োজন করা যায় তা নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে সঙ্ঘের সন্ন্যাসীদের। আদালতের রায় না দেওয়া পর্যন্ত সেই আলোচনায় কোনও সিদ্ধান্ত না হলেও বড় আকারে মেলা করা যে ঠিক হবে না, তা আলোচনায় উঠে এসেছিল বলেই জানা গিয়েছে।
যদিও সঙ্ঘ পরিবারের ধর্মীয় সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দাবি, গঙ্গাসাগরের স্নান বন্ধ করা চলবে না। পরিষদের দাবি, আদালত যা-ই বলুক, সরকারের উচিত অতিমারি পরিস্থিতি মাথায় রেখে সঠিক ব্যবস্থা করা। তার জন্য কিছু পরামর্শ দিতেও তৈরি পরিষদ।
রাজ্যের তো বটেই দেশের অন্যান্য প্রান্ত থেকে সাধারণ মানুষ গঙ্গাসাগরে মকরসংক্রান্তির দিনে পুণ্যস্নান করতে আসেন। সাগরে জমায়েত হয় দেশের নানা প্রান্তের বিভিন্ন মঠ ও সংগঠনের সন্ন্যাসীদের। মূলত সন্ন্যাসীদের স্নানের ঘাট পরিচালনার দায়িত্বে থাকে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। এ ছাড়াও পুণ্যার্থীদের স্নান থেকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা দেখতে অনেক মানুষের প্রয়োজন হয়। এর জন্য কয়েকশো গৃহী স্বেচ্ছাসেবককে মেলায় নিয়ে যাওয়া হয় সঙ্ঘের উদ্যোগে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ নিয়ে অসুবিধায় পড়েছে সঙ্ঘ।
সঙ্ঘের শীর্ষপদে থাকা এক সন্ন্যাসীর কথায়, ‘‘সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী, গৃহীদের পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে সঙ্ঘের ছাত্রাবাসের বাসিন্দারাও স্বেচ্ছাসেবক হিসেব মেলায় যান। কিন্তু এখন করোনার কারণে ছাত্রাবাসগুলি ফাঁকা। স্বেচ্ছাসেবকরা সঙ্ঘের সন্ন্যাসীদের নির্দেশ পেলে মেলায় যেতে রাজিও হয়ে যাবেন। কিন্তু নির্দেশ দেওয়া কতটা ঠিক হবে সেটাও বিবেচনার বিষয়।’’ ওই সন্ন্যাসী আরও বলেন, ‘‘আদালত ও সরকার যা সিদ্ধান্ত নেবে, তাতেই আমাদের সায় রয়েছে। হিন্দু পরম্পরার সঙ্গে সমাজের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা সমান। তাই অনড় অবস্থানে না গিয়ে আমার সমাজের পক্ষে মঙ্গলকর হবে এমন সিদ্ধান্তে যেতে চাই। মেলা পরেও করা যাবে। কিন্তু করোনা চিরকাল থাকবে না। গুরুমহারাজের আশীর্বাদে একদিন করোনার শাপমুক্ত হবে পৃথিবী। তখন আবার আগের মতো মেলার আয়োজন করা যাবে। এখন পরিস্থিতি বিবেচনা করে পদক্ষেপ করা উচিত। সরকারকেও আমরা এমনটাই জানিয়েছি।’’
তবে এতটা ‘উদারতা’ দেখাচ্ছে না বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। সংগঠনের বক্তব্য, রাজ্য সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আগে থেকে উদ্যোগ নিলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হত না। মেলা বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ যে বিষয়টিকে ‘হিন্দুদের প্রতি বঞ্চনা’ হিসেবে তুলে ধরতে পারে, তেমন ইঙ্গিতও মিলেছে।
পরিষদের সর্বভারতীয় নেতা শচীন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, ‘‘আদালতের বাইরের সমাধান খোঁজেনি রাজ্য সরকার। কোনও অবস্থাতেই এতদিনের পরম্পরা ভাঙা যাবে না। মেলা করতেই হবে। কপিলমুনির আশ্রমে গোটা দেশের পূণ্যার্থীরা পুজো দিতে আসেন। তাঁদের বঞ্চিত করা যাবে না।’’
করোনাকালে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মেলা করার জন্য তিনটি প্রস্তাবও দিয়েছেন শচীন্দ্রনাথ। তিনি বলেন, ‘‘ধর্মে কোথাও বলা নেই যে, একদিনেই সবাইকে সাগরে স্নান করতে হবে। পণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বলে রাজ্য সরকার বেশ কয়েকটি তিথি ঘোষণা করতে পারে। সেই মতো অল্প অল্প করে পুণ্যার্থীকে মেলায় যাওয়ার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। দুই, কলকাতার বাবুঘাট-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মকরসংক্রান্তির দিনে প্রতীকী গঙ্গাস্নানের আয়োজন করা যেতে পারে। রাজ্য সরকারের ব্যবস্থায় সেখান পুণ্যার্থীরা কোভিডবিধি মেনে স্নান করবেন। আর তৃতীয় প্রস্তাব হল, এখনও রাজ্য সরকার বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-সহ রাজ্যের সব সামাজিক সংগঠনকে নিয়ে একটা জরুরি বৈঠক করুক। সরকারের নজরদারিতে সব সংগঠন একসঙ্গে কাজ করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy