(বাঁ দিকে) বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। —ফাইল ছবি।
‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। তৃতীয় দফায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই সেই কথা শুনতে হয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। সিঙ্গুরে জমি আন্দোলন এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত রতন টাটাকে তাঁর স্বপ্নের ন্যানো প্রকল্প বাংলা থেকে সরিয়ে নিতে হয়। বাংলায় শিল্পগঠনের স্বপ্নও ভেস্তে যায় বুদ্ধদেবের। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সিঙ্গুরের বাসিন্দা হিসাবে সেই আন্দোলনে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। যাঁকে রাজনীতির লোকেরা ‘সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই’ হিসাবেই চেনেন। নিজের রাজনৈতিক জীবনে নানা বদল ঘটানো রবীন্দ্রনাথ এখন বলছেন, সিঙ্গুর ছেড়ে টাটারা চলে যাওয়ায় বুদ্ধদেবের কোনও দোষ ছিল না। যত দোষ ছিল সিপিএম পলিটব্যুরোর! যদিও সিপিএমের নথি সে কথা বলে না। জমি অধিগ্রহণ নীতিতে বুদ্ধদেব সরকারেরই ‘পদ্ধতিগত ভুল’ ছিল বলে সমালোচনাও করা হয় পলিটব্যুরোর পক্ষে।
মাস্টারমশাই তৃণমূলের টিকিটে সিঙ্গুর থেকে বিধায়ক হয়ে রাজ্যের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু ২০২১ সালে বয়সের কারণে তাঁকে টিকিট দেয়নি তৃণমূল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিজেপিতে যোগ দিয়ে সিঙ্গুরে পদ্মের প্রার্থী হন তিনি। কিন্তু জিততে পারেননি। সেই সময়ে সিঙ্গুরে শিল্প না হওয়ার জন্য মমতাকে দায়ী করতেও ছাড়েননি রবীন্দ্রনাথ।
২০০৬ সালে তৃতীয় দফায় মুখ্যমন্ত্রী হয়েই সিঙ্গুরে টাটার কারখানা বানানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। ছোট গাড়ির কারখানা বানাতে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন তিনি। বাংলার রাজনীতির ইতিহাস বলছে, সিঙ্গুরের মাটিতেই থেকে বুদ্ধদেব এবং তাঁর দল সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের পতনের বীজ রোপিত হয়েছিল। পরে তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল নন্দীগ্রামের রক্তক্ষয়ী জমি আন্দোলনও। ২০০৮ সালে সিঙ্গুর থেকে প্রস্তাবিত কারখানা গুটিয়ে গুজরাতের সানন্দে নিয়ে চলে যায় টাটা গোষ্ঠী। আর ২০১১ সালে বুদ্ধদেব ও বামজমানার ইতি। তবে ঘটনাচক্রে, টাটার ন্যানো গাড়ি বাজারে সফল হয়নি। সেই গাড়ির উৎপাদনও বন্ধ করে দিয়েছে টাটা গোষ্ঠী।
বুদ্ধদেবকে বরাবর ‘কৃষিবিরোধী’ তকমা দিয়েছেন মাস্টারমশাই। কিন্তু বৃহস্পতিবার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াণের পরে তাঁর বক্তব্য, ‘‘সে দিন সিঙ্গুরে টাটার কারখানা হলে বাংলার ছবিটাই বদলে যেত। শুধু সিঙ্গুর নয়, গোটা রাজ্যের শিল্পায়নের ছবিটা আলাদা হত এখন।’’ এটা কি বিলম্বিত বোধোদয়? রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘তা নয়। এটা আমি আগেও বলেছি যে, কৃষকেরা স্বেচ্ছায় যে জমি দিয়েছিলেন সেখানে কারখানা বানালেই হয়ে যেত। তাতে রাজি ছিলেন বুদ্ধদেববাবুও। কিন্তু সিপিএম পলিটব্যুরো তা হতে দেয়নি।’’
প্রসঙ্গত, সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার টাটাকে সিঙ্গুরে ছোট গাড়ি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই মতো রাজ্যের শিল্প উন্নয়ন নিগমের সঙ্গে চুক্তি হয় টাটার। সিঙ্গুরের পাঁচটি মৌজা বেরাবেড়ি, খাসেরভেড়ি, সিঙেরভেড়ি, বাজেমেলিয়া ও গোপালনগরের মোট ৯৯৭ একর জমি চিহ্নিত করে অধিগ্রহণ করা হয়। তাতেই শুরু হয় আন্দোলন। জমি দিতে ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকেরা দাবি করেন, তাঁদের উর্বর জমি জোর নিতে পারবে না সরকার। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতার নেতৃত্বে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যান সিঙ্গুরের কৃষকেরা। কারখানার কাজ প্রায় ৮০ শতাংশ শেষ হয়ে গেলেও পিছু হটতে হয় টাটাকে। ২০০৮ সালে সিঙ্গুরের প্রকল্প বাতিল করে টাটা।
সেই সময়ের কথা উঠতে বুদ্ধদেবের প্রয়াণে শোকপ্রকাশের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘টাটারা সিঙ্গুর থেকে চলে যাওয়ায় শুধু সিঙ্গুরের ক্ষতি হয়নি, গোটা রাজ্যের ক্ষতি হয়েছে। টাটা চলে যাওয়ার পর সে ভাবে রাজ্যে আর কোনও শিল্প আসেনি।’’ এখন রাজনীতি থেকে অনেক দূরের বাসিন্দা নবতিপর রবীন্দ্রনাথ বৃহস্পতিবার মমতাকে দোষেননি। তিনি মনে করান, জমি আন্দোলন তুঙ্গে থাকার সময়ে তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর নেতৃত্বে কৃষক এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যে একটা ‘বোঝাপড়া’ হয়েছিল। তাঁর কথায়, ‘‘তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং শিল্পমন্ত্রী ছিলেন নিরুপম সেন। অপর পক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমরাও ছিলাম। তখন এই রকম ঠিক হয়েছিল যে, স্বেচ্ছায় যত জমি কৃষকেরা দিয়েছেন তাতে টাটা গোষ্ঠী শিল্প করবে।’’ এ নিয়ে চুক্তিও হয়েছিল দাবি করে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা পলিটব্যুরোয় পাঠিয়েছিল। কিন্তু পলিটব্যুরো সেই প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে। ফলে টাটার কারখানা না হওয়া বা বাংলায় শিল্পায়ন না হওয়ার দায় বুদ্ধদেববাবুর নয় মোটেও। আসল দোষ পলিটব্যুরোর।’’
যদিও সিপিএমের নথিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছিল যে, বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার যে ভাবে জমি অধিগ্রহণ করেছিল, তা দলের ‘শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি’র সঙ্গে খাপ খায় না। সিঙ্গুর পর্বেই তৎকালীন বাম সরকারের মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা দিল্লিতে সিপিএমের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের কাছে গিয়ে জমি অধিগ্রহণে রাজ্য সরকারের ‘আগ্রাসী মনোভাব’-এর বিরুদ্ধে চিঠি দিয়েছিলেন। পলিটব্যুরো সেই সময়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীকে সতর্কও করেছিল। এমনকি, ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম ‘শূন্য’ হয়ে যাওয়ার পরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি যে পর্যালোচনা করেছিল, তাতেও উল্লেখ ছিল বুদ্ধদেব জমানার জমি অধিগ্রহণ নীতির ‘ত্রুটির’ কথা। প্রসঙ্গত, পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা পরবর্তী কালে মেনে নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব নিজেও। ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার রায় দেয়। সেই সময়ে বুদ্ধদেব বলেছিলেন, ‘‘প্রক্রিয়াগত ত্রুটি থাকলেও উদ্দেশ্য সৎ ছিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy