(বাঁ দিক থেকে) প্রমোদ দাশগুপ্ত, বিমান বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
বৃহস্পতিবার তিনি কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। বন্ধু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মরদেহ দেখে বেরিয়ে বিমান বসু কোনও মতে বলছিলেন, ‘‘বসা অবস্থা থেকে উঠতে কষ্ট হচ্ছিল। আমার বন্ধু চলে গেল! কথা বলার অবস্থায় নেই। প্লিজ়! কিছু বলতে চাই না।’’
বলে অশীতিপর বিমান উঠে পড়লেন সাদা বোলেরো গাড়ির সামনের আসনে। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবের পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি থেকে বিমানের গাড়ি যখন রওনা দিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের উদ্দেশে, তখন সিপিএমে আলোচনা শুরু হয়েছে ‘সপ্তরথী’ নিয়ে। যে সাত তরুণকে নেতৃত্বে তুলে এনেছিলেন প্রয়াত প্রাক্তন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত (দলে যিনি ‘পিডিজি’ নামে পরিচিত ছিলেন)। বুদ্ধদেবের প্রয়াণের পর আরও একা হয়ে গেলেন বিমান। ‘সপ্তরথী’র শেষ ‘রথী’।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে দোতলার ঘরে বৃহস্পতিবার সকালে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছিলেন বিমান। রাজ্য দফতরে খবর তখন পৌঁছে গিয়েছে, প্রয়াত বুদ্ধদেব। কিন্তু বিমানকে সঙ্গে সঙ্গে সেই খবর জানানো যায়নি। তাঁরও বয়স হয়েছে। তাই হঠাৎ করে তাঁকে মৃত্যুসংবাদ দিতে চাননি রাজ্য দফতরের কর্মীরা। পরে দু’জন নেতা গিয়ে বিমানকে বলেন। তার পরেই পাম অ্যাভিনিউয়ের উদ্দেশে রওনা হন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান।
ষাটের দশকের গোড়ায় ছাত্র-যুব অংশ থেকে সাত নেতাকে ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন প্রমোদ। তাঁরা ছিলেন অনিল বিশ্বাস, দীনেশ মজুমদার, শঙ্কর গুপ্ত, শ্যামল চক্রবর্তী, সুভাষ চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং বিমান বসু। এঁদের মধ্যে অকালে প্রয়াত হন দীনেশ। ১৯৮০ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে যুবনেতা দীনেশের প্রয়াণ হয়। উল্লেখ্য, সিপিআই থেকে সিপিএম তৈরি হওয়ার পর বিভিন্ন রাজ্যে প্রাদেশিক যুব সংগঠন তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে বাংলায় তৈরি হয়েছিল গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন (ডিওয়াইএফ)। সেই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব। সভাপতি ছিলেন দীনেশ। ছাত্র সংগঠনে ছিলেন বাকিরা।
বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে বাম ছাত্র আন্দোলন বিভিন্ন বাঁক নিয়েছিল ষাট এবং সত্তরের দশকেই। ১৯৬২ সালের চিন-ভারত সীমান্ত সংঘাত, ১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলন, ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালে দু’টি যুক্তফ্রন্ট সরকার গড়ে ওঠা এবং ভেঙে যাওয়া, পাশাপাশিই নকশাল আন্দোলন— ‘ক্রান্তিকাল’ পেরিয়েছিল মূলধারার বাম আন্দোলন। সেই ধারা থেকেই উত্থান হয়েছিল বিমান-বুদ্ধ-শ্যামল-সুভাষদের।
‘সপ্তরথী’র মধ্যে দীনেশের পর ১৯৮৩ সালে প্রয়াত হন শঙ্কর। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৪২ বছর। রাজ্য সম্পাদক থাকাকালীন ২০০৬ সালের ২৬ মার্চ বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে অকস্মাৎ প্রয়াত হন অনিল। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৯সালের ৩ অগস্ট প্রয়াত হন সুভাষ। ২০২০ সালে এই অগস্ট মাসের ৬ তারিখে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন শ্যামল। বৃহস্পতিবার চলে গেলেন ষষ্ঠ রথী বুদ্ধদেব।
সাত জনের মধ্যে পাঁচ জন সংসদীয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। শ্যামল, সুভাষ, শঙ্করেরা মন্ত্রীও থেকেছেন দীর্ঘ দিন। বুদ্ধদেব মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ১১ বছর। কেবল অনিল এবং বিমান ছিলেন সংগঠনে। কখনও কোনও ভোটে লড়েননি। ১৯৮০ সালের লোকসভা ভোটে বিমানকে বাঁকুড়া লোকসভায় লড়তে বলেছিলেন প্রমোদ। কিন্তু পিডিজি-কে বিমান জানিয়েছিলেন, তিনি সংসদীয় রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত হতে চান না। তাঁর ইচ্ছা, সংগঠনেই থাকবেন। জানা যায়, প্রমোদই বিমানকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বাঁকুড়ায় প্রার্থী করার মতো কাউকে খুঁজে বার করতে। সেই নির্দেশ মেনেই বিমান খুঁজে বার করেছিলেন বাসুদেব আচারিয়াকে।
রাজনৈতিক জীবনে বুদ্ধদেব এবং বিমানের বন্ধুত্ব যেমন ছিল, তেমনই দলের মধ্যে মতামত নিয়ে বিরোধও ছিল। ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যে প্রস্তাব অ-কংগ্রেস দলগুলি দিয়েছিল, তা নিয়ে সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটিতে ভোটাভুটি হয়। সিপিএম সূত্রে তখনই জানা গিয়েছিল, সেই সময়ে জ্যোতিবাবুর প্রধানন্ত্রিত্বের বিরোধিতা করেছিলেন বিমান। আবার বুদ্ধদেব ছিলেন বসুর প্রধানমন্ত্রিত্বের পক্ষে। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিরোধী ছিলেন বিমান। আবার বুদ্ধদেব ছিলেন জোটের পক্ষে। তবে বন্ধুত্ব ছিল অটুট। সেই বন্ধুকে হারালেন বিমান। হয়ে গেলেন একা। সপ্তরথীর শেষ রথী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy