হাইড রোডের স্টুডিওয় পুলিশ। তবে আসল নন, অভিনেতা! বুধবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
বন্ধ গেটের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে সাদা উর্দি পরা কয়েকটা চেহারা। বুক পকেটে আঁটা নেমপ্লেট (বাইনোকুলার ছাড়া এত দূর থেকে সেটা পড়া অবশ্য অসম্ভব)। খুব খুঁটিয়ে চারপাশে নজরদারি চালাচ্ছেন কলকাতা পুলিশের ওই অফিসারেরা। ঘুরে-ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথাও বলছেন।
নীলপাড় সাদা শাড়ি, লম্বাহাতা নীল ব্লাউজে কয়েক জন মহিলা পুলিশকেও দেখা গেল। দু’নম্বর ফ্লোরের দিকে একটি ঘরে ঢুকে গেলেন কয়েক জন পুলিশ। তিন দিন আগে আনন্দবাজার পত্রিকা ও এবিপি আনন্দ-এর সাংবাদিক-চিত্রসাংবাদিকদের মারধরের পরে ওই ঘরেই আটকে রাখা হয়েছিল।
তবে কি পি-৫১ হাইড রোড এক্সটেনশনে শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস-এর দখল করা জমিতে পুলিশি তদন্ত শুরু হয়ে গেল? সমালোচনার মুখে পড়ে কি অবশেষে আইন মোতাবেক কাজ শুরু করল পুলিশ?
প্রশ্নটা কাউকে করার আগেই ফটকের সামনে এসে থামল একটা ট্যাক্সি। নামলেন দু’জন তরুণী। তাঁদের গেট খুলে দিলেন নিরাপত্তারক্ষী। ভেতরে তাকিয়ে এক তরুণী বিড়বিড় করে অন্য জনকে প্রশ্ন করলেন, ‘‘আজ সেটে এত পুলিশ কেন?’’
অন্য তরুণী তাঁর কৌতূহল মিটিয়ে দিলেন। আর সেই উত্তরেই পরিষ্কার হয়ে গেল, বিতর্কিত স্টুডিও কেন এ দিন পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। তরুণীটি বললেন, ‘‘সে কী রে! এরা তো নকল পুলিশ! সবাই পুলিশের অ্যাক্টিং করছে।’’
অর্থাৎ একটু আগে দেখা ওই উর্দিধারীদের সঙ্গে লালবাজারের কোনও সম্পর্ক নেই। আছে লাইট-সাউন্ড ক্যামেরার সঙ্গে! ওঁরা নিতান্তই পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করছেন কোনও ছবি বা ধারাবাহিকে। যার শ্যুটিং চলছে কলকাতা বন্দরের জমি জবরদখল করে বানানো ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ওই স্টুডিওয়।
রবিবার এই জমির দখল নিতে এসেছিলেন বন্দরের অফিসার ও রক্ষীরা। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই গুন্ডা লাগিয়ে ভেঙ্কটেশ সেই জমি ফের নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় বলে অভিযোগ। সেই গুন্ডাবাহিনী সাংবাদিকদের বেধড়ক পিটিয়েছিল। থানায় দায়ের হয়েছিল অভিযোগ। সেই অভিযোগ নিয়ে ‘সত্যিকারের’ পুলিশ কী করছে?
সোজা কথায়, জমি জবরদখল বা সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা নিয়ে আইনরক্ষকদের এখনও কোনও তাপ-উত্তাপ দেখা যায়নি। তবে ঘটনার পরে পরপর দু’দিন— সোম ও মঙ্গলবার এ তল্লাটে ‘আসল’ পুলিশ এসেছিল। ঘটনার তদন্ত করতে নয়, জবরদখলকারীদেরই পাহারা দিচ্ছিল ওই পুলিশবাহিনী। বুধবার অবশ্য তাদেরও আর দেখা যায়নি।
কেন? তারাতলা থানার এক পুলিশ অফিসার বলেন, ‘‘বেআইনি দখলদারেরা ভেতরে রয়েছে আর বাইরে বসে পুলিশ তাদের আগলে রেখেছে— এটা খুবই দৃষ্টিকটূ লাগছে। তাই লালবাজার মনে করছে, এখন আর ভেঙ্কটেশের জমিতে পাহারা বসানোর দরকার নেই। তবে ওই তল্লাটে টহলদার পুলিশ জায়গাটির দিকে নজর রাখছে।’’
যদিও সাংবাদিক নিগ্রহের তদন্ত যে থমকে গিয়েছে, অফিসারদের সঙ্গে কথা এগোতেই সেটা বোঝা গেল। তারাতলা থানার এক অফিসার বললেন, ‘‘অভিযোগপত্রে যে পাঁচ জনের নাম লেখা হয়েছিল, তাঁরা তো আত্মসমর্পণ করেছেন। জামিনও পেয়ে গিয়েছেন, ঝটপট। তবে আর তদন্ত করার কী আছে?’’ কিন্তু ওই ক’জন ছাড়াও তো আরও অনেকে হাজির ছিলেন গোলমালের সময়ে। যাঁদের নাম জানা যায়নি, কিন্তু সাংবাদিকদের গায়ে হাত তুলেছিলেন। এঁদের বিষয়ে কী সূত্র পেল পুলিশ?
প্রশ্নটা হেসে উড়িয়ে দিলেন লালবাজারের এক কর্তা— ‘‘আরে ধুর, কেউ কি বলবে সে মারধর করেছিল? কী করে প্রমাণ হবে? আর এগোনোর রাস্তা নেই।’’ প্রশ্ন করা হল, সন্দেহভাজনদের জেরা করে প্রমাণ বের করাটাই তো পুলিশের কাজ। প্রশ্নটা যেন শুনতেই পেলেন না পুলিশকর্তাটি। ডিসি (সাউথ-ওয়েস্ট) রশিদ মুনির খান শুধু বললেন, ‘‘তদন্তের নতুন খবর কাউকে বলা যাবে না। এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতারের খবর নেই।’’
অনেক অফিসার অবশ্য একান্তে (অবশ্যই নাম না প্রকাশের অনুরোধ-সহ) আগেও বলেছেন, এখনও বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ শ্রীকান্ত মোহতার সংস্থার বিরুদ্ধে অতি-সক্রিয় হয়ে ঝক্কি পোহাতে চান না তাঁরা।
আর যা-ই হোক, এই একটি জায়গায় হয়তো আসল আর নকল পুলিশে কোনও তফাত নেই।
আপাতত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy