Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

মা-বাবার ঝগড়ায় পড়া হয়নি, চিঠি খাতায়

চৈত্র ফুরিয়ে গ্রীষ্ম এসে গেল। মাধ্যমিকের খাতা দেখাও শেষ। উচ্চ মাধ্যমিকের পাটও চুকল বলে। খাতা যাঁরা দেখেন, তাঁরা এত দিন ঘাড় গুঁজে উত্তর ঘেঁটেছেন। আর মাঝে-মাঝেই শিউরে উঠেছেন। প্রতি বছরই ওঠেন। তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, ছাত্রছাত্রী মাত্রেই ভালয়-মন্দে মেশানো। কিন্তু কিছু-কিছু খাতার যা ছিরি, তাতে এরা কেন আদৌ পরীক্ষা দিতে বসেছিল, সেটাই বোঝা দায়।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

চৈত্র ফুরিয়ে গ্রীষ্ম এসে গেল।

মাধ্যমিকের খাতা দেখাও শেষ। উচ্চ মাধ্যমিকের পাটও চুকল বলে। খাতা যাঁরা দেখেন, তাঁরা এত দিন ঘাড় গুঁজে উত্তর ঘেঁটেছেন। আর মাঝে-মাঝেই শিউরে উঠেছেন।

প্রতি বছরই ওঠেন। তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, ছাত্রছাত্রী মাত্রেই ভালয়-মন্দে মেশানো। কিন্তু কিছু-কিছু খাতার যা ছিরি, তাতে এরা কেন আদৌ পরীক্ষা দিতে বসেছিল, সেটাই বোঝা দায়।

পোড় খাওয়া খাতা পরীক্ষকেরা জানাচ্ছেন, বিপর্যয় মূলত দু’রকমের হয়—
১) খাতায় কোনও উত্তরই লেখা হয়নি বা নির্ঘাৎ ফেল করবে জেনেও হিজিবিজি লিখে ভরানো হয়েছে ও
২) উত্তরের বদলে আছে করুণ জীবন কাহিনি জানিয়ে কাতর অনুনয়, ‘পাশ করিয়ে দিন।’ প্রথম গোত্রে পড়ছে উচ্চ মাধ্যমিক বাংলার একটি খাতা, যেখানে ‘প্রিয় লেখক’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এক ছাত্রী লেখে, ‘১৯৪৭ সালে কলকাতার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের মূলেই ছিল কবিতা’। স্বাধীনতা, কলকাতা শান্তিনিকেতন, নয় একাকার হয়েই গেল। কারও জন্মের মূলে কী করে ‘কবিতা’ থাকতে পারে তা পরীক্ষকের বোধগম্য হয়নি।

একটি খাতায় আবার ‘বিজ্ঞান ও কুসংস্কার’ রচনায় লেখা হয়েছে, চাঁদে মানুষের পা রাখাটাই বড়সড় রকমের কুসংস্কার! এক ছাত্রীর ইতিহাস খাতা বলছে: শের শাহের আমলে ভারতে ঘোড়ার ডাকের প্রচলন হয়, কেননা আগে ঘোড়ার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোত না, শের শাহই ঘোড়াকে প্রথম ডাকতে শিখিয়েছেন। আর এক ছাত্রের মতে, মানুষকে প্রথম ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছেন শের শাহ।

কোনও খাতায় গোটা প্রশ্নপত্র নকল করা হয়েছে। কোনও খাতায় একই প্রশ্নের উত্তর লেখা হয়েছে তিন-চার বার। মাধ্যমিকের একটি খাতায় শুধু আঁকিবুকি কাটা। যা হাতে পেয়ে হতবাক প্রধান পরীক্ষকের প্রশ্ন, “ওই আঁকিবুকির সঙ্গে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, অন্য কোনও ভাষার কোনও অক্ষরের সম্পর্ক নেই, আমি নিশ্চিত! এ কী সাঙ্কেতিক উত্তর?” কেউ আবার উত্তর লিখতে না পেরে গোটা প্রশ্নপত্রটাই লিখে দিয়েছে। অঙ্ক পরীক্ষায় মুখস্থ বিদ্যা ফলাতে গিয়ে অনেকে জ্যামিতির উপপাদ্যের দিকে ঝুঁকেছে। কিন্তু ১ নম্বরের ৬টি প্রশ্নের মধ্যে দু’টির বেশি পারেনি, ২ নম্বরের ৭টি প্রশ্নেরও মোটে দু’টি পেরেছে।

বাম আমলে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এক বার সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বাংলায় কেউ শূন্য পায় কী করে?’ কী ভাবে তা সম্ভব হয়, তার একটি নজির দিয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিকের প্রাক্তন প্রধান পরীক্ষক সুশীল বশিষ্ঠ— এক বার দেখা গেল, এক জন মূল খাতার পরে অনেক পাতা নিয়েছে। মোটা করে বেঁধেছে। কিন্তু আসলে গোটা খাতায় প্রশ্নপত্র নকল করেছে, তা-ও আবার হুবহু নয়। এক-একটা প্রশ্ন থেকে একটু করে খামচে নিয়ে জগাখিচুড়ি, তাতে অনেক বাক্যের কোনও রকম মানেও দাঁড়ায়নি। যিনি খাতাটি দেখছিলেন, তিনিই যারপরনাই হতাশ হয়ে জানতে চান, ‘একটা নম্বরও তো দেওয়ার জায়গা রাখেনি, কী করি!’

এ তো গেল ভন্ডুলের গল্প। দ্বিতীয় গোত্রে আছে আর্জির করুণ রস।

কেশপুরের এক ভৌত বিজ্ঞান শিক্ষকের অভিজ্ঞতা: মাধ্যমিকের খাতায় এক ছাত্রী তিন পাতা জুড়ে চিঠি লিখেছিল। মোদ্দা কথা— তার ফেরিওয়ালা বাবা খুবই বদরাগী, পাশ করতে না পারলে যে কোনও ছেলে দেখে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবে। বহরমপুরে ভৌত বিজ্ঞানেরই খাতায় এক ছাত্রী লিখেছে: বাবা-মায়ের মধ্যে হামেশাই অশান্তি লেগে থাকায় সে ঠিক মতো পড়াশোনা করতে পারেনি। পাশ করিয়ে দিলে সে শিক্ষকের জন্য ঈশ্বরের কাছে দোয়া কামনা করবে।

পানাগড় লাগোয়া এক স্কুলের শিক্ষক অঙ্কের খাতায় দেখেন লম্বা চিঠি— ‘খুব আর্থিক কষ্ট। প্রাইভেট টিউশন নিতে পারিনি। ফেল করলে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। বাঁচিয়ে দিন স্যার’! একটি ছেলে বেশি কাকুতি-মিনতি না করে লিখেছে, ‘সারা দিন বাবার দোকানে কাজ করি। দয়া করে পাশ করিয়ে দেবেন।’

পরীক্ষার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে নিজের গাফিলতি কবুল করার ঘটনাও আছে। দুর্গাপুরের এক বাংলার শিক্ষিকার হাতে এসেছে সদ্য বিবাহিতা ছাত্রীর উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা। তাতে লেখা, ‘শ্রদ্ধেয় স্যার বা ম্যাডাম, এ বছরের গোড়ার দিকে আমার বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে বেশ কাজের চাপ। পড়াশুনায় তেমন মন দিতে পারিনি। মাঝে এক বার বেড়াতেও গিয়েছি। বড়রা বলেছিলেন, পড়াশোনা শেষ করে বেড়াতে যেতে। সে কথা শুনিনি। মাঝখান থেকে পড়াটাই হল না ঠিক করে। দয়া করে শুধু পাশ নম্বরটা দিন। পরের বার আর এমন হবে না।’

কিছু চিঠিতে আবেগের মাত্রা থাকে বাড়াবাড়ি রকমের। এক ছাত্রী যেমন জানিয়েছে: বাবা অন্য মহিলার সঙ্গে চলে গিয়েছেন, মা-ও অন্য পুরুষের সঙ্গে ঘর বেঁধেছেন। ফলে তাকে মামার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। পাশ না করালে... আত্মহত্যার হুমকিও থাকে এ রকম কিছু চিঠিতে। উচ্চ মাধ্যমিকের বাংলা খাতায় এক পরীক্ষকের প্রতি ছাত্রীর হুঁশিয়ারি— ‘দাদা-বৌদির সংসারে থাকি, বিয়ের কথা চলছে। আপনি পাশ না করিয়ে দিলে বিয়ে ভেঙে যাবে, রেল লাইনে গলা দেওয়া ছাড়া রাস্তা থাকবে না।’

সুশীলবাবুর কথায়, ‘‘এতে বহু সময়ে ধর্মসঙ্কটে পড়তে হয়। কেননা এমনও হতে পারে যে এই সব বলে আসলে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা হচ্ছে। আবার মনে হয়, সত্যিও তো হতে পারে! পাশ করতে না পেরে যদি সত্যি কিছু করে বসে! তবে একটা বড় কথা হল, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা দেখার সময়ে বেশির ভাগ শিক্ষকই ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রাখেন।’’

কিছু পরীক্ষার্থীর আবার সাধারণ অনুরোধে ঠিক ভরসা নেই। তারা বরং ‘নৈবেদ্য’ দেওয়ায় বেশি বিশ্বাসী।

রানিগঞ্জে বসে ইতিহাসের খাতা দেখছেন দিদিমণি। হাতে পড়ল ফাঁকা উত্তরপত্র। শুধু গোটা গোটা অক্ষরে নামটি লেখা। পাতা ওল্টাতেই কড়কড়ে ১০০ টাকার নোট। নীচে লেখা, ‘দয়া করিয়া পাশ করাইয়া দিবেন।’ এই অভিজ্ঞতা হয়েছে বহু জনের। তারতম্য শুধু টাকার অঙ্কে।’

এক প্রধান পরীক্ষক বলেন, “তাও তো বাঁচোয়া যে আগের মতো বড় প্রশ্নের ধরন পাল্টে গিয়েছে। বেশির ভাগটাই এখন অবজেকটিভ ধরনের। তাতে অন্তত আবোল-তাবোল লেখার বহর কিছুটা কমেছে।’’ কিন্তু যে কিছুই না জেনে কপাল ঠুকে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের মতো অগ্নিপরীক্ষা দিতে চলে গিয়েছে, তার কাছে বড়়ই বা কী আর ছোটই বা কী?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy