অবশেষে সাজা: রায় ঘোষণার পর অপর্ণা বাগের স্মারকে তাঁর মেয়েরা।
কড়া সাজা হবে, তা প্রায় সকলেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু ১১ জনেরই যে ফাঁসির আদেশ হবে, তা বোধহয় কেউ ভাবেননি।
বিচারক আগের দিনই জানিয়ে দিয়েছিলেন, সাজা হবে ফাঁসি অথবা যাবজ্জীবন। যা শুনে তখনই মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল লঙ্কেশ্বর ঘোষ-সহ ১১ জনের। তবু কিছুটা আশায় ছিলেন লঙ্কেশ্বর এবং তাঁর আইনজীবীরা। কামদুনি মামলাতেও যে সকলের ফাঁসির সাজা হয়নি! তিন জনের আমৃত্যু কারাবাসের রায় হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে কৃষ্ণনগর আদালতে নদিয়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক (তৃতীয়) পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় সাজা ঘোষণা করতেই তাই কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা এজলাস। বিষয়টা বুঝে উঠতেই কয়েক মুহূর্ত লেগে যায় সকলের। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকেন অভিযুক্তের আইনজীবীরা। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে অপরাধীরা।
প্রধান অভিযুক্ত, ঘটনার সময়ে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত লঙ্কেশ্বর ঘোষ ওরফে লঙ্কা অবশ্য কাঁদেনি। রায় শুনে ফ্যালফ্যাল করে এ দিক-ও দিক তাকায় সে। কাকে যেন খোঁজে। তার পরে মুখ নামিয়ে নেয়। খানিক পরে কাঠগড়ার পাশে দাঁড়ানো এক পুলিশ কনস্টেবলকে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে। ফের মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়।
মঙ্গলবার দোষী সাব্যস্ত করার পরে সাজা ঘোষণার কথা ছিল বুধবার। কিন্তু অন্য একটি মামলায় আদালত ব্যস্ত থাকায় তা হয়নি। একে একে ১১ জনের বক্তব্য শোনার পরে বিচারক জানিয়েছিলেন, বৃহস্পতিবার সাজা ঘোষণা করবেন। সেই মতো এ দিন সকাল থেকেই আদালত চত্বরে ভিড় করতে শুরু করে আসামিদের পরিবার। পৌনে ১২টা নাগাদ কোর্ট লক-আপ থেকে ১১ জনকে প্রিজন ভ্যানে তুলে ছোট একটি মাঠ পার করে নিয়ে আসা হয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারকের (তৃতীয়) এজলাসে। সামনে তখন ভিড় ভেঙে পড়েছে।
২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর কৃষ্ণগঞ্জের ঘুঘড়াগাছি গ্রামে যাঁকে গুলি করে মারার দায়ে এই সাজা, সেই অপর্ণা বাগের স্বামী বা দুই মেয়ে এ দিন আদালতে আসেননি। মেয়েরা আগের দিন বলেছিল, তারা ফাঁসি চায় না। বরং অপরাধীরা জেলে পচে মরলেই তাদের শান্তি। এ দিন রায় শুনে নীলিমা আর দেবিকা অবশ্য জানিয়েছে, তারা খুশি। যদিও ওই পরিবার তো বটেই, গোটা গ্রাম অজানা আশঙ্কায় থমথমে। অন্য দিকে, প্রায় স্তব্ধ কিলোমিটার চারেক দূরে লঙ্কা-বাহিনীর নাথপুর গ্রামটিও।
মাস পনেরো আগে প্রায় ২২ বিঘা বিতর্কিত জমির দখল ঘিরে ঘটনাটি ঘটেছিল। গ্রামের ৫৪টি পরিবার ওই জমি চাষ করত। ট্রাক্টর নিয়ে জমির দখল নিতে আসা লঙ্কা-বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন অপর্ণা। গুরুতর জখম হন লতিকা তরফদার ও শ্যামলী তরফদার নামে দুই মহিলা। জখম হয় রাজীব মণ্ডল নামে এক স্কুলপড়ুয়াও। পুলিশ বারো জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছিল। ১১ জন গ্রেফতার হলেও মানবেশ্বর বিশ্বাস নামে এক জন এখনও ফেরার।
শুধু সাজাপ্রাপ্তদের বাড়ির লোকজন নন, রায় শুনে বিস্মিত আইনজীবীদের একটা বড় অংশ। নদিয়া জেলার সরকারি আইনজীবী, ৮৬ বছরের সত্যেন্দুশেখর সেন বলেন, ‘‘আমার ষাট বছরের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় একসঙ্গে এত জনের ফাঁসির সাজা হতে দেখিনি।’’
কলকাতায় আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ বা বিকাশ ভট্টাচার্যেরাও একই কথা জানিয়েছেন। বিকাশবাবুর দাবি, ‘‘একই মামলায় ১১ জনের ফাঁসির সাজা স্বাধীন ভারতে নজিরবিহীন।’’ এই রায়ের যৌক্তিকতা বা ভবিষ্যৎ নিয়েও বরিষ্ঠ আইনজীবীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেন না শুধু ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ অপরাধের ক্ষেত্রেই ফাঁসির সাজা হওয়ার কথা।
আইনজীবীদের একাংশের প্রশ্ন, এই ঘটনা কি সত্যিই ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’? নির্ভয়া বা কামদুনি মামলার সামাজিক অভিঘাতের সঙ্গে এর তুলনা করা যায় কি? অথবা, ২৬/১১ বা সংসদে হানার মতো সন্ত্রাসবাদী কাজের সঙ্গে এই ঘটনা তুলনীয় কি?
অরুণাভবাবুর মতে, গোলমালে গুলি চালানোয় তা মহিলার গায়ে লেগেছিল। ১১ জনই গুলি করেননি। মহিলাকে খুন করার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। ফলে এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলে ফাঁসির সাজা খারিজ হয়ে যেতে পারে। এই খুনে তৃণমূলের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় কোনও রকম দেরি না করে অপর্ণা বাগের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিল সিপিএম। দলের আইনজীবী নেতা বিকাশবাবু মনে করছেন, যে ভাবে জমির দখল নিতে দল বেঁধে আক্রমণ করা হয়েছিল এবং গুলি চালানো হয়েছিল, তা বিচারক বিরলতম বলে মনে করেছেন বলেই হয়তো একসঙ্গে ১১ জনকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছেন।
নদিয়ার অতিরিক্ত সরকারি আইনজীবী বিকাশ মুখোপাধ্যায়ের যুক্তি, নিরপরাধ মহিলাকে খুন করা হয়েছে। মারাত্মক সব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। তাৎক্ষণিক কোনও উত্তেজনা বা প্ররোচনা বা শত্রুতাও ছিল না। কারও মানসিক বিকৃতিও নেই। গোটাটাই পূর্বপরিকল্পিত। তাঁর মতে, সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে এদের পার্থক্য নেই। সন্ত্রাসবাদীদের মতো এরাও মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহার ক’রে নিরপরাধ, অসহায় মানুষকে মেরেছে। এই ঘটনায় সমাজ ধাক্কা খেয়েছিল। শুধু ওই গ্রাম নয়, আশপাশের গ্রাম ও দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যমে খবর পড়ে বিরাট অংশের মানুষ সচকিত হয়েছিলেন। নিরপরাধ মহিলা খুন হলে তার যদি সঠিক সাজা না হয়, তা হলে আদালতের প্রতি সমাজের আস্থা চলে যাবে। এবং যিনি মারা গেলেন, তাঁর প্রতিও ন্যায় বিচার হবে না।
বিকাশবাবুর মতে, ‘‘এই সমস্ত দিক বিচার করে এবং সুপ্রিম কোর্টের কিছু রায় উল্লেখ করে বিচারক এই ঘটনাকে ‘বিরলের মধ্য বিরলতম’ বলে মন্তব্য করে ১১ জনের ফাঁসির নির্দেশ দিয়েছেন।’’ আসামি পক্ষের আইনজীবী কাজল ঘোষ বলেন, ‘‘এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব। রায়ের কপি ভাল করে না দেখা পর্যন্ত এর বেশি কিছু মন্তব্য করব না।’’
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy