Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
নির্যাতিতাই জেলবন্দি

বোমা আইনে ধৃত, হেফাজত বারো দিনের

পুলিশি নির্যাতনের সুবিচার এখনও পাননি। তার আগেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে গেলেন বধূ। বীরভূমের সাত্তোরে এই ঘট়নায় নির্যাতিতার উপরে পুলিশ তাদের পুরনো আক্রোশ মেটাল বলে অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা। বধূটির পরিবার বিজেপি সমর্থক।

জামিন পাওয়ার পর সাত্তোরের নির্যাতিতাকে রূপার আলিঙ্গন। সিউড়ি আদালতে তাপল বন্দ্যোরাধ্যায়ের তোলা ছবি।

জামিন পাওয়ার পর সাত্তোরের নির্যাতিতাকে রূপার আলিঙ্গন। সিউড়ি আদালতে তাপল বন্দ্যোরাধ্যায়ের তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৫ ০৩:৪০
Share: Save:

পুলিশি নির্যাতনের সুবিচার এখনও পাননি। তার আগেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে গেলেন বধূ। বীরভূমের সাত্তোরে এই ঘট়নায় নির্যাতিতার উপরে পুলিশ তাদের পুরনো আক্রোশ মেটাল বলে অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা।

বধূটির পরিবার বিজেপি সমর্থক। এর আগে ১৭ জানুয়ারি রাতে বধূর ভাসুরপোকে খুঁজতে এসে বধূকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। রাতভর গাছে বেঁধে বধূকে নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। নির্যাতিতা সংবাদমাধ্যমের কাছে
দাবি করেছিলেন, তাঁর শাড়ি-ব্লাউজ ছিঁড়ে দিয়ে শরীরে বিছুটি পাতা ঘষে দেওয়া হয়েছিল। ধারালো অস্ত্র দিয়ে চিরে দেওয়া হয়েছিল হাতের তালু। ঘটনাটি বর্তমানে বিচারাধীন। জমা পড়েছে চার্জশিট।

কিন্তু শনিবার ৪ জুলাই, সেই বধূই একাধিক জামিন-অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার হয়ে গিয়েছেন। শিশুসন্তান-সহ বধূকে নিয়ে গিয়ে রাতভর সিউড়ি মহিলা থানায় রেখে দেয় পুলিশ। রবিবার আদালতে হাজির করানো হলে বধূর ১২ দিনের জেল হাজতের নির্দেশ হয়েছে।

বধূর ‘অপরাধ’? শনিবার সকালে সাত্তোরে তৃণমূল পার্টি অফিসে বোমা মজুত রয়েছে বলে অভিযোগ এসেছিল পুলিশের কাছে। কিন্তু বিকেল পর্যন্ত তা উদ্ধার করেনি পুলিশ। সেই বিক্ষোভে ওই দিন বিকেলে সাত্তোর বাসস্টপ এলাকায় বোলপুর-সিউড়ি রাস্তা অবরোধ করেন বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা। সেই দলে ছিলেন ওই বধূও। বোমা উদ্ধার না করলে অবরোধ তোলা হবে না বলে পুলিশকে জানিয়ে দেন অবরোধকারীরা। তখন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দগোপাল রায়, এসডিপিও (বোলপুর) অম্লানকুসুম ঘোষ ঘটনাস্থলে যান। তাতেও কাজ না হওয়ায় সন্ধ্যায় নির্যাতিতা এবং তাঁর স্বামী-শাশুড়ি এবং স্থানীয় তিন বিজেপি কর্মী বাবর আলি, শেখ সফিউল ও শেখ হাফিজুলকে তুলে নিয়ে যায় পাড়ুই থানার পুলিশ। তাই নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয় এলাকায়। রাস্তায় বোমা ফাটানো হয় বলে পুলিশের দাবি। তাদের বক্তব্য, মহিলা শুরু থেকেই দুর্ব্যবহার করছিলেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ তাঁদের সকলকেই গ্রেফতার করে।

রবিবার দুপুরে ধৃতদের সিউড়ি সিজেএম আদালতে হাজির করানো হয়। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৩ (‌বেআইনি জমায়েত), ৩৫৩ (সরকারি কর্মীকে হেনস্থা), ১৮৬ (সরকারি কর্মীর কাজে বাধা), ৫০৬ (হুমকি) ও ৩/৪ (বোমা মজুত রাখা ও ফাটানো) ধারায় মামলা রুজু করেছে পুলিশ। এর মধ্যে দু’টি (৩৫৩ ও ৩/৪) জামিন অযোগ্য। বিরোধীদের প্রশ্ন, তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল পুলিশকে প্রকাশ্যে বোমা মারার হুমকি দিলে পুলিশ তাঁকে ধরার সাহস দেখায় না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনি জামিন পেয়ে যান। অথচ নির্যাতিতার বেলায় জামিন অযোগ্য ধারা কেন? শাসক দলের পার্টি অফিসে বোমা উদ্ধারের ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হল? কী মামলা রুজু হল?

এ সব প্রশ্নে জেলা পুলিশের মুখে কুলুপ। পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও উত্তর দেননি।

সাত্তোরের সাতকাহন

বিজেপির রূপা গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শমীক ভট্টাচার্য, সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী থেকে বিকাশ ভট্টাচার্য, কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী এবং আব্দুল মান্নান— প্রত্যেকেরই অভিযোগ, পুলিশ নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই নির্যাতিতাকে ফাটকে পুরেছে। শাসক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে যে পুলিশ ঠুঁটো হয়ে বসে থাকে, এমনকী নিজেরা আক্রান্ত হলেও আজকাল যে পুলিশ সক্রিয় হয় না, সেখানে সাত্তোরের ধ়ৃতদের ক্ষেত্রে যে রকম তড়িৎ গতিতে কাজ সারা হয়েছে, তার পিছনে পরিকল্পিত ছক রয়েছে বলেই তাঁদের দাবি। সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘বীরভূমে তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা উচিত পুলিশের, সেটা তারা এনেছে এক নির্যাতিতা মহিলার বিরুদ্ধে!’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘লজ্জাজনক, কলঙ্কজনক ঘটনা! সাত্তোরের মানুষ তৃণমূলকে এক দিন এর জবাব দেবে!’’

১৭ জানুয়ারি রাতে বর্ধমানের কলমডাঙার জঙ্গলে এই বধূর উপরে তৃণমূলের কিছু নেতা-কর্মীর প্ররোচনায় পুলিশ যে অত্যাচার চালিয়েছিল, সেই অভিযোগে আগেও রাজ্য রাজনীতিতে কম তোলপাড় হয়নি। পুলিশ ও প্রশাসন বিষয়টিকে লঘু করতে চাইলেও এ ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলা রুজু করে কলকাতা হাইকোর্ট। চাপের মুখে সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেয় রাজ্য সরকার। ক্লোজ করা হয় মূল অভিযুক্ত স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপের (এসওজি) ওসি কার্তিকমোহন ঘোষকে। সিআইডি তার প্রথম চার্জশিট জমা দেয় ১২ মার্চ। কিন্তু সেই চার্জশিট অসম্পূর্ণ বলে বাতিল করে সিউড়ি আদালত। সিআইডি দ্বিতীয়বার চার্জশিট জমা দেয় ১৭ এপ্রিল। ওসি কার্তিকমোহন, কনস্টেবল দীপক বাউরি ও কাশীনাথ দাস, ইলামবাজার থানার মহিলা কনস্টেবল আলপনা লোহার সকলেই আগাম জামিন পান। তার পরেই সিআইডি তদন্তে অনাস্থা জানিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন নির্যাতিতা। বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘আগামী ৭ জুলাই হাইকোর্টে সাত্তোর মামলার শুনানি আছে।

সেই শুনানিতে মহিলা যাতে হাজির হতে না পারেন, তার জন্য পরিকল্পনা করে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে।’’ নির্যাতিতার আত্মীয়দেরও অভিযোগ, পুলিশের কর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মাসুল দিতে হচ্ছে তাঁদের পরিবারকে। শাসক দলের অঙ্গুলিহেলনেই এমনটা ঘটছে। তৃণমূল নেতৃত্বের অবশ্য দাবি, পুলিশের কাজের সঙ্গে তাঁদের জড়ানো ঠিক নয়। দলের অন্যতম জাতীয় সম্পাদক ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘পুলিশের কাজে আমরা হস্তক্ষেপ করি না। আইন আইনের পথেই চলবে। কে কী বলছেন, তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’’

এ দিন বেলা ১টা নাগাদ কড়া পুলিশি প্রহরায় ধৃতদের সিউড়ি সিজেএম আদালতে হাজির করানো হয়। অভিযুক্তের পক্ষে জামিনের জন্য সওয়াল করেন আইনজীবী তথা বিজেপি নেতা নির্মল মণ্ডল। নির্মলবাবু ভারপ্রাপ্ত সিজেএম ঋষি কুশারিকে বলেন, ‘‘শনিবার সাত্তোরে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে বোমা পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশ তা উদ্ধার করেনি। গোটা ঘটনা থেকে নজর ঘোরাতে আমার মক্কেলদের ফাঁসানো হয়েছে।’’ তাঁর দাবি, ধৃত মহিলা আগে একাধিক পুলিশ অফিসারের নামে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন। সেই আক্রোশ মেটাতেই পুলিশ মিথ্যা মামলায় ধৃতদের ফাঁসিয়েছে। শিশু কোলে নিয়ে এক জন মহিলা কী ভাবে বিস্ফোরক হাতে পুলিশকে হেনস্থা করতে পারেন, তা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন।

এ দিন এজলাসে হাজির করানোর সময়ে পুলিশ নির্যাতিতার শিশুপুত্রকে ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। শিশুটি বাইরে পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় মাকে দেখতে না পেয়ে কান্না জুড়েছিল। সেই কান্না এজলাসেও শোনা যাচ্ছিল। অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী বিচারকের কাছে আবেদন করেন, বাবা-মা এবং ঠাকুমাকে ছাড়া চার বছরের একটি শিশু কী ভাবে থাকবে। নির্মলবাবু বিচারককে বলেন, ‘‘শিশুটিকে পুলিশ তাঁর মায়ের সঙ্গেই তুলে এনেছে। ওকে ওর মায়ের সঙ্গেই জেলে থাকার অনুমতি দেওয়া হোক।’’ বিচারক তা মঞ্জুর করেন। পাড়ুই থানার পুলিশের অবশ্য দাবি, গ্রেফতারের সময় শিশুটি নির্যাতিতার সঙ্গে ছিল না।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE