ফাইল চিত্র।
তৃণমূল কংগ্রেসের বিভাজনের ছবি দিল্লির সংসদীয় দলেও ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, দলের পরামর্শদাতা সংস্থা আইপ্যাকের ভূমিকা এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক আচরণ নিয়ে ক্ষোভের স্বর। পাশাপাশি দলের একাংশের অনুমান, গোয়া নির্বাচনে তৃণমূলের ফল আদৌ ভাল হবে না।
বৃহস্পতিবারই দলের পরামর্শদাতা সংস্থা প্রশান্ত কিশোরের আইপ্যাককে সমর্থন করা নিয়ে সৌগত রায়ের মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। লোকসভার সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে নেত্রীর নির্দেশ জানিয়ে বলেছেন, এই নিয়ে যেন ভবিষ্যতে মুখ না খোলেন সৌগতবাবু। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতির বয়স নিয়ে যা যা মন্তব্য করেছিলেন, তাকেও সমর্থন করেছিলেন সৌগত। অভিষেকের সুরে সুর মিলিয়ে তিনি বুঝিয়েছিলেন, দলে ষাটোর্ধ্বদের অবসর নেওয়ার বিষয়টিতে তিনি সহমত পোষণ করেন। এই গোটা বিষয়টি নিয়ে লোকসভার এক ক্ষুব্ধ সাংসদের বক্তব্য, “সৌগতবাবু ৭৫ বছর বয়সে এসে এই বোধোদয় হল কেন? তিনি তো ষাট বছরেই কলেজ থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তার পরেও রাজনীতি চালিয়ে গেলেন কেন? পনেরো বছর চুটিয়ে রাজনীতি করে, বিধায়ক সাংসদ হয়ে এখন এই সব বলার অর্থ কী?” আজ সৌগতবাবুকে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমার যা বক্তব্য, আমি বলেছি। নতুন করে আর কিছু বলতে চাই না।”
দলের শীর্ষ পর্যায়ের এক সাংসদের বক্তব্য, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেই যে তৃণমূলের ভবিষ্যতের কান্ডারি হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন, তা নিয়ে আপত্তি ছিল না দলের পুরনো নেতাদের। বরং এটাকেই স্বাভাবিক উত্তরাধিকার হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের অভিযোগ, ধাপে ধাপে না এগিয়ে, মমতাকে অনুসরণ না করে দ্রুত উত্থানের চেষ্টা
করছেন অভিষেক।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তৃণমূলের লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চান, দলে নবীন এবং প্রবীণের সংমিশ্রণ। তিনি মাঝখানে জেলাসফর, প্রশাসনিক বৈঠক, নবান্নের কাজের গতি এবং রুটিনমাফিক দলীয় কর্মসূচির মধ্যে আবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত সঠিক সময়ে দলের হাল এমন ভাবে ধরলেন, যাতে তৃণমূল ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী হবে।” তাঁর কথায়, “শুধু তৃণমূলে নয়, গোটা বাংলাতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও বিকল্প নেই। যে দল তিনি ১৯৯৮ সালে তৈরি করেছিলেন, তার ধারেকাছে দেশের কোনও আঞ্চলিক দল নেই। ৩৪ বছরের বাম সরকারকে হটানো প্রায় ব্রিটিশদের দেশ থেকে তাড়ানোর মতোই বিষয় ছিল। সেটা একক ভাবে মমতা করে দেখিয়েছেন। সেই কৃতিত্বের ভাগীদার অন্য কেউ হবে, তার কোনও সুযোগই নেই।”
চলতি বাদল অধিবেশনে তৃণমূলের সংসদীয় দলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তৃণমূল কংগ্রেসের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব, যা দেখে কংগ্রেসের বর্তমান পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন রাজধানীর রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসিদের জি-২৩, রাহুলের নতুনপন্থীদের সামনে নিয়ে আসা, সনিয়ার পুরনো সেনাদের বাতিল করার প্রবণতা — এ সবই যেন এখন দেখা যাচ্ছে তৃণমূলে। রাজধানীর রাজনৈতিক শিবিরের মতে, তৃণমূলের মধ্যে এমনটা আগে দেখা যায়নি।
তৃণমূলের একাংশের অভিযোগ, অভিষেকের উত্থানে ‘জি-৫’, অর্থাৎ দলের পাঁচ গুরুত্বপূর্ণ নেতার প্রতিনিয়ত সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাঁদের নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করা এবং মৌরসিপাট্টা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বেশি করে নতুন মুখ তুলে আনার জন্য কিছু পদ থেকে এই নেতাদের কয়েক জনকে সরানো হয়েছে। ফলে তাঁরা সংসদের দলীয় অফিস বা সেন্ট্রাল হলে বসেই খোলাখুলি নিজেদের ক্ষোভ তুলে ধরছেন। দলের ভাবমূর্তির কথা ভাবছেন না।
অন্য অংশের অভিযোগ, গত বছরের শেষে কলকাতা ও বিধাননগর-সহ কয়েকটি পুরসভা ও পুরনিগমে ভোটের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুমোদন ছাড়াই ৩ জন প্রার্থীর নাম চুড়ান্ত তালিকায় শেষ মুহূর্তে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পি কে তথা আইপ্যাকের ‘অতিসক্রিয়তা’ মমতা যে অনুমোদন করছেন না, তার প্রমাণ প্রথম মেলে সেই সময়েই। কলকাতার প্রার্থী ঠিক করার সময় বৈঠকে উপস্থিত আইপ্যাকের প্রতিনিধি তাঁদের সুপারিশ মানা হচ্ছে না বলে অনুযোগও করেন। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাতে বিশেষ আমল দেননি। বরং বলে দেওয়া হয়, বাংলাকে বুঝতে অন্য কারও পরামর্শ লাগবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও পি কে-র সংস্থার চাপে শেষ মুহূর্তে তালিকায় কিছু রদবদল করা হয়েছিল বলে অভিযোগ তৃণমূলের এক বর্ষীয়ান নেতার। তবে তিনি এটাও জানাচ্ছেন, তা নিয়ে বিশেষ কোনও ক্ষোভবিক্ষোভ সে সময় হয়নি।
গোয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দু’বার নিয়ে যাওয়া এবং সেখানে বিধানসভায় লড়ে কংগ্রেসকে আক্রমণ করা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তৃণমূলের অন্দরেই। শীর্ষ সূত্রের খবর, গোয়ায় দলের লড়ার ব্যাপারে মমতা নিজেই প্রাথমিক ভাবে ইচ্ছুক ছিলেন না। বরং তাঁর বক্তব্য ছিল, পঞ্জাবে লড়াই করা রাজনৈতিক ভাবে অধিকতর লাভজনক হবে। এ রাজ্যের সঙ্গে পঞ্জাবের মানুষের দীর্ঘ সামাজিক যোগাযোগের কারণে। গোয়ার সঙ্গে বাংলার সে ভাবে কোনও যোগসূত্রই নেই। প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কাদের নিরন্তর প্রয়াসে গোয়ায় যেতে হল দলকে? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, তৃণমূল নেতৃত্বের রাহুল গান্ধীর প্রতি ‘অ্যালার্জির’ কারণে কংগ্রেসকে বিরোধী রাজনীতিতে নেতৃত্বের আসনে বসতে না দেওয়া এক বিষয়। কিন্তু যে রাজ্যে (গোয়া) কংগ্রেসই বিজেপির প্রধান বিরোধী দল, সেখানে গিয়ে কংগ্রেসকে আক্রমণ করার অর্থ, খোলাখুলি ভাবে বিজেপিকে সুবিধা করে দেওয়া। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় স্তরে ভুল বার্তা গিয়েছে, যা দলনেত্রীর পক্ষে অস্বস্তিকর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy