Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

সিবিআই-ফেরত শঙ্কুর জন্য দরজা বন্ধ তৃণমূলে

দ্বিতীয় দিন সিবিআইয়ের মুখোমুখি হওয়ার পরেই তৃণমূলের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল শঙ্কুদেব পণ্ডাকে। এমনকী, তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনে তাঁর প্রবেশাধিকারও নিষিদ্ধ হয়ে গেল রাতারাতি! শঙ্কুর সঙ্গে যোগাযোগ না-রাখার জন্য দলের সব নেতা-কর্মীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৪:২৪
Share: Save:

দ্বিতীয় দিন সিবিআইয়ের মুখোমুখি হওয়ার পরেই তৃণমূলের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল শঙ্কুদেব পণ্ডাকে। এমনকী, তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনে তাঁর প্রবেশাধিকারও নিষিদ্ধ হয়ে গেল রাতারাতি! শঙ্কুর সঙ্গে যোগাযোগ না-রাখার জন্য দলের সব নেতা-কর্মীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় সোমবার রাতে বলেন, ‘‘তদন্তের স্বার্থে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে শঙ্কুকে অপসারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি। তদন্ত চলাকালীন তিনি দলের কোনও পদে থাকবেন না!’’ তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের ব্যাখ্যা, জেলে যাওয়ার পরেও মন্ত্রী থাকায় মদন মিত্রের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ আনতে পেরেছিল সিবিআই। শঙ্কু অবশ্য মদনের মতো জনপ্রতিনিধি নন। তবে দলের পদাধিকারী থাকলে তাঁকেও প্রভাবশালী আখ্যা দেওয়া হতে পারে, এই আশঙ্কাতেই পদ থেকে তাঁকে সরানো হয়েছে।

যদিও দলের অন্য অংশের বক্তব্য, আশঙ্কা আসলে আরও গভীরে! ডিসেম্বরের ২ তারিখে প্রথম বার সিবিআইয়ের কাছে গিয়ে প্রাক্তন ছাত্রনেতা শঙ্কু বলে এসেছিলেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের জ্ঞাতসারেই তিনি সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন। এবং সেই টাকার বেশির ভাগটাই তৃণমূলের কাজে লাগানো হয়েছিল। আর এ দিন তিনি সিবিআইয়ের জেরার মুখে শাসক দলের কিছু নেতা-মন্ত্রী-সাংসদের নাম বলে এসেছেন বলে জল্পনা ছড়ায়। তৃণমূলের অন্দরের খবর, তার পরেই কালীঘাট থেকে দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির নেতাদের কাছে নির্দেশ আসে, শঙ্কুকে দলের পদ থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে। এক কালে যে ‘শঙ্কু স্যারে’র দাপটে রাজ্যের যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা কলেজের অধ্যক্ষেরা থরহরি কম্প ছিলেন, এক ধাক্কায় তাঁর জন্যই বন্ধ হয়ে যায় তৃণমূল ভবনের দরজা!

পূর্ব মেদিনীপুরের আঠিলাগোড়ির সাতমাইলের বাসিন্দা শঙ্কুর কলকাতার ঠিকানা এত দিন ছিল তৃণমূল ভবনের তিনতলা। এই বাড়িতে দলের বাইরের কারও প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত হতো তাঁর নির্দেশেই। সেখানে সাংবাদিক বৈঠকের আয়োজনও করতেন তিনিই। তবে সিবিআই তলব করতে পারে, এই আঁচ পেয়ে কিছু দিন আগে নিজেই সেখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছিলেন শঙ্কু। এ বার দলের তরফে সদর দফতরের দরজা শঙ্কুর জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে তৃণমূল নেতাদের কারও কারও আশঙ্কা, ‘‘শঙ্কু আদৌ কারও নাম বলেছে কি না, কে জানে! এখন বিরূপ হয়ে সে যদি আরও নাম বলে দেয়, তখনই বা কী হবে?’’

শঙ্কু অবশ্য এ দিন অন্তত প্রকাশ্যে কোনও বিদ্রোহী মনোভাব দেখাননি। দলের সিদ্ধান্ত জানার পরে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমি দলের অনুগত সৈনিক। দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। দলের সিদ্ধান্ত শিরোধার্য।’’

সারদা-দুর্নীতিতে দলের অনেক নেতা-নেত্রীর নাম জড়ানোয় গোড়ায় পথে নেমে তার প্রতিবাদ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনৈতিক স্বার্থে সিবিআই-কে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ছিল তাঁর। কিন্তু ইদানীং তৃণমূল নেত্রীর অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে! সম্প্রতি তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, কেউ চুরি করে থাকলে তার দায় সেই ব্যক্তির। এর জন্য দল দায়ী নয়। শঙ্কুকে পদ থেকে অপসারণ মমতার এই সাম্প্রতিক অবস্থানেরই প্রতিফলন বলে দলের একাংশের বক্তব্য।

বিরোধীরা প্রত্যাশিত ভাবেই তৃণমূলের ‘অপারেশন শঙ্কু’ নিয়ে সরব। কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান যেমন বলেছেন, ‘‘এই ভাবে কি তৃণমূলের মাথারা বাঁচতে পারবেন? ঠগ বাছতে তো গাঁ উজা়ড় হয়ে যাবে!’’ সিপিএমের আইনজীবী-নেতা বিকাশ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘তৃণমূল নেত্রীর দিকে যে আঙুল তুলবে, ওই দলে তার জায়গা হবে না! সেই কুণাল ঘোষের সময় থেকেই তৃণমূল এই নীতিতে চলছে।’’ আর বিজেপি-র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের তির্যক মন্তব্য, ‘‘গ্রামের দিকে একটা কথা আছে, মড়ার চুল ছিঁড়ে মড়া হাল্কা করা যায় না! সেই কথাটাই মনে পড়ছে!’’

আরও পড়ুন:
নেতাদের জানিয়েই টাকা নিয়েছি, দাবি শঙ্কুর
ফের ডাকা হবে শঙ্কুকে, এক তৃণমূল সাংসদকেও তলব করল সিবিআই
নোটিস দিয়ে সিবিআই ডেকে পাঠাচ্ছে শঙ্কুকে

সারদা-শঙ্কু যোগের অকাট্য প্রমাণ হাতে পেয়েই তলব, বলছে সিবিআই

সিবিআই দফতরে শঙ্কু

তেরো দিনের ব্যবধানে এ দিন সিবিআই দফতরে যান শঙ্কু। প্রথম দিন জেরায় সারদা-কাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত নন বলে দাবি করেন তিনি। তদন্তকারীরা তখন পাল্টা বলেন, সারদা থেকে প্রায় কোটি টাকা তিনি নিয়েছেন। কী কাজের জন্য ওই টাকা নেওয়া হয়েছে, শঙ্কুকে তার নথি দাখিল করতে হবে। সিবিআইয়ের দাবি, শঙ্কু কিছুটা সময় চান। তিন দিন সময় দেওয়া হলেও তিনি নির্দিষ্ট দিনে হাজির হননি। তখন ফের তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তদন্তকারীরা। এ দিন দুপুরে সিবিআই দফতরে হাজির হন শঙ্কু। তদন্তকারীরা জানান, শঙ্কুর কাছে যে সব নথি চাওয়া হয়েছিল, তার একটি বড় অংশই তিনি এ দিন জমা দিতে পারেননি।

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্ত প্রশ্নেও শঙ্কু সন্তুষ্ট করতে পারেননি তদন্তকারীদের। শঙ্কুর বাবা এক জন অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি পরিবহণ কর্মী, মা গৃহবধূ। এমন আর্থিক অবস্থা সত্ত্বেও কী ভাবে তাঁদের বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি হল— এই প্রশ্নের যে জবাব শঙ্কু দিয়েছেন, তাতে বিস্তর অসঙ্গতি রয়েছে বলে সিবিআইয়ের দাবি। তাঁকে ফের জেরার জন্য ডাকা হতে পারে বলে সিবিআইয়ের এক কর্তা জানান।

শঙ্কুর পাশাপাশি তৃণমূলের রাজ্যসভার এক সাংসদকে ডাকারও প্রস্তুতি করছে সিবিআই। তদন্তকারীরা জানান, ওই সাংসদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই টেলিফোনে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, সংসদের অধিবেশন শেষ হলে তিনি তদন্তকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

শঙ্কুকে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি এ দিন সিবিআই অ্যাঞ্জেল অ্যাগ্রিটেক নামে একটি অর্থলগ্নি সংস্থার ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা এবং এ রাজ্য মিলিয়ে মোট ২০টি জায়গায় হানা দিয়েছে। সিবিআইয়ের দাবি, শেখ নাজিবুল্লা, হাসিবুল হক, সুনির্মল গোস্বামী, অরিন্দম পাল, বাসুদেব ঘোষ, ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায় নামে এই সংস্থার বেশ কয়েক জন ডিরেক্টরের বাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়েছে। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি। তদন্তকারীদের দাবি, এই সংস্থার সঙ্গেও শাসক দলের একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির যোগাযোগের বিষয়টি সামনে এসেছে।

সারাদা কেলেঙ্কারি নিয়ে এত দিন জেলাস্তরে বিক্ষোভ করার পরে এ বার রাজ্যস্তরে আন্দোলনে নামতে চলেছে বামফ্রন্ট। সারদা-সহ বিভিন্ন বেসরকারি আর্থিক সংস্থায় লগ্নিকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া এবং দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবিতে ১২ জানুয়ারি বিধাননগরের সিবিআই দফতর সিজিও কমপ্লেক্সের সামনে অবস্থান করবে বামেরা। তদন্তের কাজে সিবিআই অযথা দেরি করছে— এই অভিযোগ তুলে ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, ‘‘যা অবস্থা মনে হচ্ছে, তৃণমূলের সঙ্গে সিবিআইয়ের দমরম মহরম রয়েছে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

MostReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE