আব্দুল করিম চৌধুরী। — ফাইল চিত্র।
ইদানীং নিজেকে ‘বিদ্রোহী বিধায়ক’ বলে পরিচয় দিচ্ছেন প্রকাশ্যে। ১১ বার বিধানসভা ভোটে জিতে বিধায়ক হয়েছেন। তিনি চলতি বিধানসভার প্রবীণতম সদস্যও বটে। বয়স এখন ৭৬ বছর। খাতায়কলমে তিনি শাসকদল তৃণমূলের বিধায়ক। কিন্তু সম্প্রতি তিনি বিরোধীদের চেয়েও বেশি ‘রুষ্ট’। বলছেন, রাজ্যসভায় ভোটাভুটি হলে তৃণমূলের প্রার্থীদের ভোট দিতেন না। রাজ্য সরকার বিধানসভায় কোনও বিল আনলে তাতেও ভোট দেবেন না।
এমন নয় যে, তাঁর ভোট না-পেলে রাজ্যসভায় তৃণমূলের প্রার্থীরা জিততেন না বা তাঁর ভোট না-পেলে সরকার পড়ে যাবে বা কোনও বিল পাশ আটকে যাবে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে শাসকদলের প্রতি একটি ধারনা তো তৈরি হবেই। যা ‘নেতিবাচক’ হওয়াই স্বাভাবিক।
শীর্ষনেতৃত্বের একাংশের দিকে আঙুল তুলে তিনি বলছেন, ‘‘অনেক দিন আগে ইসলামপুরে খুনের ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। সেই সময়ে তাঁকে আমি শীর্ষনেতাদের ভুমিকা নিয়েও জানিয়েছিলাম। কিছু পাইনি বলে আমি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছি, এ কথা সত্যি নয়। পঞ্চায়েত ভোটের মতো সন্ত্রাস এবং অনৈতিক কাজ হলে আমি বারবার সরব হব। বিদ্রোহ আরও বাড়বে। তাই বলেছি, বিধায়ক হিসেবে রাজ্যসভার ভোটে ভোট দিতাম না। বিল পাশের ক্ষেত্রেও ভোটদানে বিরত থাকব। এমন ঘটনা ঘটলে দেশের রাজনীতিতে ঢেউ উঠবে।’’
কিন্তু কিসের রাগ আব্দুল করিম চৌধুরীর? কোথায় সমস্যা? কেন ঢেউ তুলতে চান তিনি?
সোমবার তাঁকেই সরাসরি প্রশ্ন করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। করিম বলেছেন, তাঁর এই বিদ্রোহের কারণ উত্তর দিনাজপুর জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ ও শীর্ষনেতৃত্বের কয়েকজন। তাঁর কথায়, ‘‘ব্যবসা করতে করতে রাজনীতিতে এসে হাতে হঠাৎ ক্ষমতা এলে যা হয়, উত্তর দিনাজপুর জেলা তৃণমূলের একাংশ নেতাদের তাই হয়েছে। তাঁরা ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন! প্রবীণদের কী ভাবে সম্মান দিতে হয় জানেন না। কী ভাবে রাজনীতি করতে হয়, তা-ও জানেন না!’’
এর অর্থ কি জেলার রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত নবীনদের তুলনায় পিছিয়ে পড়া? তৃণমূল নেতৃত্বেরও ব্যাখ্যা তেমনই। দলের প্রথমসারির নেতাদের মতে, উত্তর দিনাজপুর জেলার রাজনীতিতে গুরুত্ব কমে যাওয়াতেই হঠাৎ হঠাৎ এমন ‘বিদ্রোহী’ হয়ে উঠছেন করিম।
আপাতত উত্তর দিনাজপুর জেলায় শাসকদলের ‘প্রধান মুখ’ জেলা সভাপতি কানহাইয়ালাল আগরওয়াল এবং মন্ত্রী গোলাম রব্বানি। নতুন ভাবে জেলার রাজনীতি উঠে আসছেন ইটাহারের যুবা বিধায়ক মোশারফ হোসেন। নতুনদের সঙ্গে লড়াইয়ে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছেন করিম। সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটেও তাঁর মনোনীত প্রার্থীদের টিকিট দেয়নি দল। তাই বাধ্য হয়েই নিজের অনুগামীদের ‘নির্দল’ হিসেবে খাড়া করে পঞ্চায়েত ভোটে ‘মুখরক্ষা’ করেছেন তিনি। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে ৪০ জনের বেশি এবং পঞ্চায়েত সমিতিতে ৮ জন ‘করিম নির্দল’ জয়ী হয়েছেন। ‘বিদ্রোহী’ করিম তাঁদের নির্দেশ দিয়েছেন, তৃণমূলের থেকে প্রস্তাব না এলে গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতি গঠন নিয়ে নীরব থাকতে।
তবে তৃণমূলের অন্দরে করিমের ‘বিদ্রোহ’ এই প্রথম নয়। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে রায়গঞ্জ লোকসভা আসন জোটের স্বার্থে কংগ্রেসকে ছেড়ে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সিদ্ধান্ত মানতে না পেরে তৃণমূল ছেড়ে ‘নির্দল’ হয়ে রায়গঞ্জ লোকসভায় প্রার্থী হন করিম। তাতে অবশ্য জিততে অসুবিধা হয়নি ওই ভোটে কংগ্রেস প্রার্থী দীপা দাশমুন্সির। করিমের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। তার পর বাধ্য ছাত্রের মতো ‘ঘর ওয়াপসি’ হয় করিমের। ২০১১ সালের ইসলামপুর বিধানসভা থেকে জয়ী হওয়ার পরে তাঁকে গ্রন্থাগারমন্ত্রী করেছিলেন মমতা। পাঁচ বছরের মন্ত্রিত্বের সময়কালে কোনও দলবিরোধী মন্তব্য করেননি তিনি। বরং তাঁর জমানায় সরকারি গ্রন্থাগারে সংবাদপত্র রাখা নিয়ে তাঁর দফতরের একটি বিজ্ঞপ্তি নিয়ে বিতর্ক বেধেছিল।
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের পর করিমের দ্বিতীয় বার ‘বিদ্রোহ’ করেন। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী কানহাইয়ালালের কাছে পরাজিত হন করিম। জয়ের কয়েক মাস পরেই কানহাইয়ালাল যোগদান করেন তৃণমূলে। কংগ্রেস বিধায়ককে দলে নেওয়ার ওই সিদ্ধান্ত মানতে না পেরে বিদ্রোহী হয়ে তৃণমূল ছাড়েন করিম। গঠন করেন নিজের রাজনৈতিক মঞ্চ। তখন তিনি নিয়ম করে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই বিবৃতি দিতেন। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় আবার অবস্থান বদল হয় করিমের। তৎকালীন উত্তর দিনাজপুর জেলা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারীর ‘মধ্যস্থতায়’ তৃণমূলে ফেরেন তিনি। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূলের প্রার্থী হন কানহাইয়ালাল। তাই ইসলামপুর বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়ে তাঁকে। ইসলামপুরের উপনির্বাচনে করিমকেই টিকিট দেয় তৃণমূল। দশম বার জিতে বিধানসভায় ফেরেন তিনি।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে আবার ইসলামপুরে দাঁড়িয়ে বড় ব্যবধানে জয় পেলেও এ বার আর তাঁকে মন্ত্রিসভায় জায়গা দেওয়া হয়নি। বরং ওই জেলা থেকে গোয়ালপোখরের বিধায়ক গোলাম রব্বানিকে আবার মন্ত্রিসভায় নিয়ে যান মমতা। তৃণমূলের একাংশের মতে, করিমের ‘বিদ্রোহী’ হওয়ার বড় কারণ মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না পাওয়া। সেই থেকেই দলের বিরুদ্ধে নানা সময়ে তির্যক মন্তব্য করতে শুরু করেন করিম। এক বার উত্তর দিনাজপুর জেলার প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে প্রকাশ্যেই চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা বেশি দিন থাকেনি। গত বছর অগস্ট মাসে রাজ্য মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণে প্রথম বারের বিধায়ক হেমতাবাদের সত্যজিৎ বর্মনকে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী করেন মমতা। ওই ঘটনার পর প্রকাশ্যেই বিদ্রোহী মেজাজ বাড়িয়ে দিয়েছেন করিম।
প্রসঙ্গত, গত বছর বিধানসভায় তৃণমূল পরিষদীয় দলের এক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভায় উপস্থিতির হার নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীকে বেজায় ‘অস্বস্তি’-তে ফেলেছিলেন ইসলামপুরের করিম। অভিযোগ করেছিলেন, ইসলামপুরের ব্লক সভাপতি চয়নের ক্ষেত্রেও তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
কিন্তু সে রাগও বেশি দিন থাকেনি। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যখন ‘জনসংযোগ যাত্রা’ উত্তর দিনাজপুর পৌঁছেছিল, তখন অনেক আশা নিয়ে নিজের বাড়ির সামনে লাল কার্পেট বিছিয়ে অভিষেকের আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন করিম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করিমের বাড়িতে যাননি অভিষেক। তাতে খানিক ‘অভিমানী’ হলেও অভিষেকের বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য করেননি তিনি।
তবে করিমকে নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্বের একটি বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তাঁর ‘ঘনিষ্ঠতা’। তৃণমূল ছেড়ে শুভেন্দু বিজেপিতে যোগদান করার পর তৃমমূলের কেউ সে ভাবে তাঁর সঙ্গে সৌজন্যের সম্পর্কও রাখেননি। ‘ব্যতিক্রম’ করিম। তিনিই একমাত্র শুভেন্দুর সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ রেখে চলেছেন। বিধানসভায় দেখা হলেও শুভেন্দু-করিম হাসিমুখে কথা বলেছেন। দলের অনেকেই তার সাক্ষী। সেই কারণেই করিমের ‘বিদ্রোহ’-কে গুরুত্ব দিতে নারাজ দল। তবে করিম প্রসঙ্গে তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার বক্তব্য, ‘‘প্রথমত, ওঁকে মন্ত্রী করা হয়নি। সেই থেকেই ওঁর রাগের শুরু। আর এ বছর ব্লক কমিটি গঠনের সময় করিম নিজের ছেলেকে ব্লক সভাপতি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দল অন্য একজনকে ব্লক সভাপতি করায় ওঁর বিদ্রোহ বেড়ে গিয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy