এত দিনের দম বন্ধ করা অপেক্ষাটা বদলে গেল উচ্ছ্বাসে। কেউ চিৎকার করছেন, কারও চোখে জল। গ্রামের স্কুলের কাছে ক্লাবঘর, গুটিকয়েক টিভিওয়ালা-বাড়ি থেকে ভিড়টা ছিটকে পথে নামল। দু’আঙুল তুলে ‘ভিকট্রি’ দেখানো মহিলাদের জটলার পিছনে দেখা গেল তাঁকে। ছোটখাটো ক্ষয়াটে চেহারার যুবক। স্থানীয় তৃণমূল নেতা সনাতন মণ্ডল ওরফে সোনা। হাসি মুখে বললেন, ‘‘এ তো আমাদেরই জয়! এই দিনটার জন্যই গোটা কামদুনি অপেক্ষা করছিল!’’
টিভির ব্রেকিং নিউজে তিন অভিযুক্তের ফাঁসির আদেশ তখন সবে জানতে পেরেছে কামদুনি। তার পরই বদলে যাওয়া ছবিটা চোখে পড়ল। গ্রামের মেয়ে ধর্ষিতা ও খুন হওয়ার পরে ক্ষোভের আবহে যাঁরা কার্যত একঘরে হয়েছিলেন, শনির বিকেলে জয়ের উচ্ছ্বাসে সামিল তাঁরাও।
ওই তল্লাটে আর এক তৃণমূল নেতা, বারাসত দু’নম্বর ব্লকের কার্যকরী সম্পাদক মতিয়া সাঁপুইও ধর্ষণ-কাণ্ডের নিন্দা করছিলেন। তার পরে একটু থেমে বললেন, ‘‘যাদের ফাঁসি বা যাবজ্জীবন হল, তারাও খুব গরিব। পরিবারগুলোর জন্য খারাপ লাগছে। এটা ঠিক হলো না।’’
আড়াই বছর আগের ঘটনার পর থেকেই টানাপড়েনে জড়িয়ে পড়েছিল শাসক দল। মানুষের ক্ষোভের আঁচে বেকায়দায় পড়েছিলেন তৃণমূল নেতারা। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গিয়ে গ্রামের ক’জন মহিলাকে ‘মাওবাদী’, ‘সিপিএম’ তকমা দেওয়ার প্রতিবাদে পথে নেমেছিল গোটা কামদুনি। ধর্ষণ-কাণ্ডের দিন কুড়ির মধ্যে পঞ্চায়েত ভোটে গোটা গ্রাম কার্যত মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের মুখ পুড়েছিল। দোষীদের সাজা ঘোষণার দিনে সেই তৃণমূল নেতারাই কিন্তু মানুষের আবেগে সওয়ার হলেন।
এ দিন আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙেছিল কামদুনির। সকাল থেকে গ্রামের বাইরে পুলিশ পাহারা। নস্করপাড়ার এক বধূ বলছিলেন, ‘‘সকাল-সকাল সাজা ঘোষণা হবে ভেবে সাড়ে চারটে-পাঁচটাতেই ভাতে-ভাত ফুটিয়ে নিই। বাড়ির ছেলেরাও অনেকে খবর দেখবে বলে চাষের কাজ করতে যায়নি।’’
প্রতিবাদী আর উচ্ছ্বাসে ভরপুর কামদুনির সঙ্গে মধ্যবর্তী-পর্বের কামদুনির একটা ফারাক আছে। মাঝে দীর্ঘ সময় খোলসের মধ্যে গুটিয়ে ছিল গ্রামটা। ‘প্রতিবাদী মঞ্চ’ ভেঙে পাল্টা ‘শান্তি কমিটি’ গড়ায় ইন্ধন জুগিয়েছিল শাসক দল। কখনও খিচুড়ি-ভোজে, কখনও ফুটবল-প্রতিযোগিতায় গ্রামবাসীদের কাছে টেনে বা প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে প্রতিবাদ ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল তারা। ব্যতিক্রম মৌসুমী আর টুম্পা কয়াল। কামদুনিতে সরাসরি অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস দেখাননি আর কেউই। কেন? গ্রামের এক যুবক বলছিলেন, ‘‘নানা ভাবে জুলুম চলেছে। ভেড়িতে ভাগের টাকায় বেশির ভাগ লোকের সংসার চলে। পার্টির নেতারা তা বন্ধ করার হুমকি দিয়েছিল। জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে কি লড়াই চলে?’’ এ দিনের উচ্ছ্বাস অবশ্য ভয়-ডরের তোয়াক্কা করেনি। হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শাসক দলের নেতারাও গণ-আবেগের শরিক। বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত গ্রামের মেঠো রাস্তা আর বড় মাঠে জমায়েত। নির্যাতিতার বাড়ির উঠোনে মোমবাতি-স্মরণ। মৃতার পরিবার কামদুনি ছেড়ে চলে গিয়েছে অনেক দিন। এ দিন সন্ধ্যায় মৃতার দুই ভাই পুলিশের গাড়িতে গ্রাম ঘুরে গেলেন। কামদুনির এই সব টুকরো দৃশ্যে শাসক দলের কয়েকটা মুখও দিনভর মিশে থেকেছে। সোনা ও তাঁর সঙ্গীরা সেই দলে অন্যতম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy