গণনার পরে। —ফাইল চিত্র
প্রচারে এসে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের মুখে বলেছিলেন সোনামুখী এলাকায় আসলে প্রার্থী তিনিই। তাঁকে প্রার্থী ভেবেই যাতে মানুষ ভোট দেয় সেই আর্জিও জানিয়েছিলেন। কিন্তু গোটা রাজ্য যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর ফের আস্থা রাখল, মুখ ফিরিয়ে নিলেন সোনামুখীর মানুষ। এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী দীপালি সাহার পরাজয় নিয়ে তাই যথেষ্ট অস্বস্তিতে এলাকার তৃণমূল কর্মীরা। রাস্তাঘাটে, হাটে-বাজারে অনেক তৃণমূল কর্মীকেই আক্ষেপ করতে শোনা গিয়েছে, “কেন যে সে দিন দীপালির সঙ্গে নিজেকে জড়াতে গেলেন দিদি! ওর ভাবমূর্তির সঙ্গে কী দিদির তুলনা চলে!”
তৃণমূল সূত্রের খবর, দীপালিদেবীর দৌলতে এ বারের নির্বাচন যে বিশেষ সুখের হতে যাচ্ছে না, তা অনেক আগে থেকেই টের পেয়ে গিয়েছিল তৃণমূল শিবিরের একাংশ। তাঁদের মতে, একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে এলাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা হারিয়েছিলেন এই প্রাক্তন বিধায়ক। সে লোকসভায় ছাপ্পা ভোট করানোই হোক বা পুরভোটের সময় বহিরাগত লোকজন শহরে ঢুকিয়ে হামলার ছক কষার অভিযোগ। সব ক্ষেত্রেই এলাকাবাসীর কাছে দীপালিদেবীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে।
লোকজন নিয়ে থানায় গিয়ে দিপালীদেবী কখনও পুলিশকে শাসিয়ে বলেছেন, ‘‘আপনার উর্দি খুলে নেব।’’ কখনও আবার ধর্ষণে অভিযুক্ত পড়শি যুবকের হয়ে সওয়াল করেছেন। এক বধূকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ায় অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা সুব্রত দত্ত ওরফে গোপে-র গ্রেফতারি আটকাতে পুলিশকে চাপ দেওয়ার অভিযোগও উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। সেই গোপেকেই আবার এ বারে নিজের নির্বাচনী এজেন্ট করেছিলেন দিপালীদেবী। এই নিয়ে ভোটের মুখে দলের অন্দরে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছিল তাঁকে।
শুধু গোপেই নয়, বিরোধীদের অভিযোগ, গত পাঁচ বছরে এলাকার বিভিন্ন পারিবারিক ঝামেলায় নাক গলানো দীপালি ঘনিষ্ঠ নেতা-কর্মীদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার অন্যতম উদাহরণ হিসাবে তাঁরা টেনে আনছেন দীপালি ঘনিষ্ঠ সোনামুখী শহরের মহিলা তৃণমূল নেত্রী পুতুল গরাইয়ের প্রসঙ্গ। চলতি বছরের গোড়ায় সোনামুখী শহরের একটি পারিবারিক দ্বন্দ্বের মিমাংসা করতে গিয়ে এক অন্তঃস্বত্ত্বা বধূর পেটে লাথি মারার অভিযোগ ওঠে পুতুলের বিরুদ্ধে। যদিও সে ক্ষেত্রে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেনি। দীপালির প্রভাবেই পুতুল গ্রেফতারি এড়িয়েছিল বলে অভিযোগ তুলেছিলেন বিরোধীরা।
অনেকেই মনে করছেন, এমন নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে দীপালির ভাবমূর্তি ক্রমশ নষ্ট হয়েছে সোনামুখীর মানুষের কাছে। তার উপরে যোগ হয়েছে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। সোনামুখীর পুরপ্রধান তথা পোড় খাওয়া তৃণমূল নেতা সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দীপালির বিবাদ অনেক পুরনো। এই দ্বন্দ্ব যে জয়ের পথে কাঁটা হবে তা বিলক্ষণ জানতেন দীপালিদেবী। এ ক্ষেত্রে বৈতরণী পার হওয়ার জন্য তাঁর ভরসা ছিল গোপে দত্তর গড় পাত্রসায়র। গত কয়েক বছরে এই এলাকাটি জেলার মানচিত্রে রাজনৈতিক সন্ত্রাস কবলিত এলাকার মধ্যে সর্বাগ্রে উঠে এসেছে। সিপিএম জোনাল কমিটি পর্যন্ত গড়তে পারেনি এই ব্লকে। সাংগঠনিক দুর্বলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যে এ বারের ভোটে পাত্রসায়রের ৮৬টি বুথের মধ্যে ৫৬টিতে সিপিএম প্রার্থী অজিত রায়ের কোনও এজেন্টই ছিল না। গত লোকসভা ভোটে এই ব্লকের বিভিন্ন বুথে ভোটে বিস্তর জল মেশানোর অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এ বারও পাত্রসায়রের ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে বিধানসভা জিতে নেওয়ার লক্ষ্যেই ঝাঁপিয়েছিলেন দীপালিদেবী।
সেখানেও বাদ সাধল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। তৃণমূল সূত্রের খবর, সুরজিতের মতোই পাত্রসায়র ব্লক তৃণমূল সভাপতি স্নেহেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও দীপালিদেবীর ঝামেলা শুরু হয়েছে রাজ্যে পালা বদলের পর থেকেই। ভোটের আগে স্নেহেশবাবুকে বাদ দিয়ে শুধু গোপেকে নিয়েই পাত্রসায়রে ভোটের ছক সাজিয়েছিলেন দীপালিদেবী। ইভিএম খোলার পর বোঝা গেল, শেষ পর্যন্ত সেই ছক মাঠে মারা গিয়েছে। লিড তো দুরের কথা, পাত্রসায়রে প্রায় এক হাজার ভোটে পিছিয়ে গিয়েছেন দীপালিদেবী। যা দেখে নেত্রী ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ, স্নেহেশ-গোষ্ঠীই অন্তর্ঘাৎ করেছে। তবে এমন অভিযোগ মানতে চাননি স্নেহেশবাবুরা।
সুরজিৎবাবুর গড় সোনামুখী পুরএলাকাতেও দু’হাজারের বেশি ভোটে পিছিয়ে গিয়েছেন দীপালিদেবী। কার্যত, সোনামুখী বিধানসভার ১৫টি গ্রামপঞ্চায়েতের মধ্যে শুধু দু’টিতে লিড পেয়ে শেষ পর্যন্ত ৮,৭১৯ ভোটে সিপিএম প্রার্থী অজিত রায়ের কাছে হার মেনেছেন খোদ দলনেত্রীর প্রার্থী দিপালীদেবী। সোনামুখীর সিপিএম নেতা তথা সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই পরাজয় আসলে দীপালিদেবীর গত পাঁচ বছরের কৃতকর্মের ফল। মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হলে যা হয়, ওঁর ঠিক সেটাই হয়েছে।”
আর এই বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে দীপালিদেবী শুধু বলেন, “কী বলব বলুন? আমার ভাগ্য! মানুষ আশীর্বাদ করেনি এটাই নিজেকে বোঝানর চেষ্টা করছি।” একটু থেকে বলেন, “মানুষের পাশে থাকার জন্য রাজনীতিতে নেমেছিলাম। যত দিন সুযোগ পেয়েছি সেই কাজটাই করেছি।” আর তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতা-কর্মীরা দিপালীদেবীর ভাবমূর্তিতে কোনও খুঁত দেখতে নারাজ। তাঁদের আক্ষেপ, “কোনও মতে যদি গোষ্ঠী কোন্দলটা একটু সামাল দেওয়া যেত, তাহলে এই দিনটা দেখতে হত না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy