ফাইল চিত্র।
ওই কালান্তক তিন ঘণ্টার কথা ভাবলে আজও আমার গলা শুকিয়ে আসে। সারা বছরের যা কিছু পড়াশোনা, রাত জাগা, গল্পের বই, সিনেমা, খেলার মাঠ স্যাক্রিফাইস করে যে অমিত পরিশ্রম, তার অন্তে পরীক্ষা নামক এক অকূলপাথার। কেউ দিব্যি পেরিয়ে যায়, কেউ কায়ক্লেশে, কেউ মাঝদরিয়ায় হাল ছেড়ে দেয়। কামাল ওই মারাত্মক তিন ঘণ্টার। ওই বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে যার যত কেরদানি, দেখাতেই হবে। পারলে ভাল, না পারলে দুয়ো। মুশকিল হল, কেউ ভেবে দেখে না, ওই তিন ঘণ্টা সময়ে কে নিজেকে কতটা প্রয়োগ করতে পারবে, কতটা কাজ করবে কার স্মৃতিশক্তি, কে কতটা সুস্থ ও স্বস্থ থাকবে, কিংবা কে কতটা দ্রুত ও নির্ভুল লিখে যেতে পারবে এবং যিনি খাতা দেখবেন, তিনিও সেই সময়ে কোন মুডে থাকবেন, কতটা নিবিষ্ট হবেন, এ সবই একটা লটারি খেলার মতো। তার পরে কে কত নম্বর পেয়ে পাশ করল, তা নিয়ে হইচই। যারা ফার্স্ট-সেকেন্ড হল বা উঁচুতে জায়গা করে নিল, তাদের নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। মুশকিল হল, যারা পারল না, তাদের নিয়ে।
আমাদের বাড়িতে যে মেয়েটি রান্না করে, তার নাম সন্ধ্যা। ওর বড় মেয়ে এ বারে মাধ্যমিক পাশ করেছে তৃতীয় বিভাগে। মেয়ের সেই কৃতিত্বে সন্ধ্যা আনন্দাশ্রু ফেলতে ফেলতে আমাকে উপুড় হয়ে প্রণাম করে গেছে। তার কারণ, ওর বাপের বাড়িতে আজ অবধি কেউ মাধ্যমিক পাশ করেনি। এ-ও তো সাকসেস। আবার শতকরা নব্বই পেয়েও বিরানব্বই না পাওয়ার দুঃখে কেউ সেটা এক ধরনের ফেলিয়োর মনে করে মনমরা হতেই পারে। একটু এ দিক-ও দিক হলেই যে সেকেন্ড হয়েছে বা থার্ড বা দশম, সে-ও হয়তো ফার্স্ট হতে পারত। আসল কথা হল, ওই কালান্তক তিন ঘণ্টা। ওই বাঁধা সময়ের মধ্যে নিজেকে কে কতটা প্রয়োগ করতে পেরেছে কিংবা খাতা দেখার সময়ে পরীক্ষক কেমন মানসিক অবস্থায় ছিলেন, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া চলছিল কি না, ছেলে বা মেয়ের বেআদবিতে রেগে ছিলেন কি না, কোনও কারণে টেনশনে ছিলেন কি না, মুড অফ ছিল কি না, না কি প্রসন্নই ছিলেন, এ সব অনেক ফ্যাক্টরও কিন্তু সামনে এসে দাঁড়ায়। এ সব তুচ্ছ কারণও এক-আধ নম্বরের হেরফের ঘটিয়ে দিতে পারে। নিজে এক সময়ে শিক্ষক ছিলাম বলেই জানি।
র্যা ঙ্ক যারা করল, তারা তো নন্দিত হলই, খানিকটা বিখ্যাতও হয়ে গেল রাতারাতি। যারা তা পেরে উঠল না, তারা নিজেদের হতভাগ্য মনে করতে শুরু করে দিল। আর এখানেই বিপদ। মেধা তালিকার ক্রম কিছুটা হলেও ভাগ্য-নির্ভর বলে আমার মনে হয়।
পরীক্ষার এই প্রচলিত ব্যবস্থা যে অনেকাংশে অবৈজ্ঞানিক এবং অস্বাস্থ্যকর, এটা অনেকেই মানেন। পরীক্ষা-নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা প্রকৃত জ্ঞানার্জনের পরিপন্থী বলেই মনে হয়। কারণ, পরীক্ষায় পাশ করার জন্য শেখা ও আত্মস্থ করার চেয়ে অনেকের মধ্যেই মুখস্থ করে উগরে দেওয়ার তাগিদ বেশি কাজ করে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, এত বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা-সমীক্ষা করার সহজতর কোনও উপায়ও তো আর নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয়ের অবরোধ তুলে দিয়ে মুক্ত প্রাঙ্গণে বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন বটে, কিন্তু তিনিও পরীক্ষা প্রথাকে তুলে দিতে পারেননি।
আমার মতে, মেধা তালিকার চেয়ে ‘গ্রেডেশন’ প্রথা চালু করলে শিক্ষার্থীদের ইঁদুর-দৌড়ে শামিল করার হাত থেকে খানিকটা বাঁচানো যায়। আর হীনম্মন্যতা থেকেও। এক বার মেধা তালিকা তুলে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্ত নম্বর দেখে নিজেরাই মেধা তালিকা তৈরি করে নিয়েছিল। উত্তেজনা এবং উন্মাদনা সৃষ্টি না করলে মানুষই বা খুশি হবে কেন?
তাই শেষ অবধি পরীক্ষার প্রকাশিত ফলে কে কতটা আলোকিত হল বা হল না, তা নিয়ে অতিরিক্ত মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই। জীবনে তার চেয়ে অনেকানেক কঠিনতর পরীক্ষা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, যেগুলো শুধু বই পড়ে পাশ করার উপায় নেই। সেই সব কঠিনতর পরীক্ষার কথা মনে রাখলে এই সব পরীক্ষাকে জলভাত মনে হবে। কোনও গ্লানি থাকবে না।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy