পাঁচগাছিয়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই সাঁওতালি মাধ্যম। স্কুল বন্ধের খবরে চিন্তার অভিভাবকেরা। —নিজস্ব চিত্র।
ফুলমণি সরেন এ গাঁয়েরই বধূ। কথায় কথায় বললেন, “যেখানে হাতির ভয়, সেখানে কি না সন্ধ্যা থেকে আলো নেই!” আলো নেই? “পথবাতি দেখলেন কোথাও?”
গাঁয়ে ঢোকার লাল মোরাম পথে এর আগেই দেখা হয়েছে নন্দলাল মান্ডি ও তাঁর স্ত্রী সীতার সঙ্গে। দু’জনে মিলে একটা মুদির দোকান চালান। অস্থায়ী। দিনভর বিক্রিবাটা সেরে সন্ধ্যায় দোকান গুটিয়ে চলে যান তাঁরা। হাতের কাজ সারতে সারতে সীতা বলছিলেন, ‘‘আবেদন করেও আবাসে বাড়ি জুটল না। একশো দিনের কাজ করেও মজুরি পাননি গ্রামের অনেকে। তা-ও নাকি আমরা ভাল আছি!’’
বালিগেড়িয়া পঞ্চায়েতের পাঁচগাছিয়া গ্রাম। ঝাড়গ্রাম জেলায় চলতে চলতে একেবারে ওড়িশা সীমানার কাছে পৌঁছে গেলে এই গ্রামের দেখা মেলে। সক্কাল সক্কাল সেখানে মাথার উপরে বর্ষার মেঘ। নয়াগ্রাম ব্লকের এই পঞ্চায়েতে যে সরকারি প্রাথমিক স্কুলটি রয়েছে, সেখানে পড়ুয়া কম। শোনা যাচ্ছে, তাই স্কুলটি তুলে দেওয়া হতে পারে। সামনেই ডাংগুলি খেলছিল জনা চারেক খুদে। তাদেরই এক জন, প্রলয় মান্ডি বলল, ‘‘স্কুল উঠে গেলে তো মুশকিল। তখন দূরের স্কুলে যেতে হবে।’’ সাঁওতাল প্রধান এই গ্রামে কেন কার্যত বাংলা মাধ্যমে স্কুলটি চলছে, ক্ষোভ আছে তা নিয়েও।
গ্রামের স্কুলপাড়া, পূর্ব পাড়া ও দক্ষিণ পাড়া মিলিয়ে আদিবাসী পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৮০টি। সকলেই সাঁওতাল। অধিকাংশ বাসিন্দা কৃষিজীবী ও খেতমজুর। বেশির ভাগ মাটির বাড়ি। সরকারি প্রকল্পে হাতে গোনা বাড়ি হয়েছে। লক্ষ্মণ টুডু বার্ধক্য ভাতা পান। দোকানে যাচ্ছিলেন জিনিস কিনতে। বৃদ্ধের কথায়, ‘‘মাথার উপরে একটা ঘর দিল না সরকার।’’ কোন সরকার, তা আর খোলসা করলেন না।
গ্রামের তরুণ রোহিত সরেন পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ি কলেজে সাঁওতালি অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়া। রোহিত জানালেন, সাইকেলে স্থানীয় পাইলট চকে গিয়ে বাস ধরে কলেজে পৌঁছতে দু’ঘণ্টা লাগে। বর্ষায় গ্রামের রাস্তার কাঁচা অংশে জলকাদায় চলাই দায়। আরও কিছুটা এগোতে দেখা গেল, স্কুল পাড়ার জবারানি হেমব্রমের নামে সরকারি প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ির কাজ অসম্পূর্ণ। টাকা পুরো পেয়েছেন, তবু বাড়ির ছাদ ঢালাই হয়নি কেন? জবা রা কাড়লেন না। এক পড়শি বলেন ওঠেন, ‘‘বল না, কোন নেতাকে কত টাকা দিতে হয়েছে?’’ নিরুত্তরই থাকেন জবা।
শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের সহায়িকা বাসন্তী মুর্মু বালতি ভরে জল আনছিলেন। জানালেন, স্কুল পাড়ার ২০টি পরিবারের জন্য একটাই সাব মার্সিবল পাম্প। প্রায়ই বিদ্যুৎ থাকে না। তখন জলও অমিল। দক্ষিণপাড়ার গোপাল মুর্মুর আক্ষেপ, ‘‘আমার জব কার্ড নেই। তাই একশো দিনের কাজ মেলেনি।’’ একই আক্ষেপ বিশু হেমব্রম পঞ্চানন হেমব্রম, দাসো হেমব্রমদের গলাতেও।
গ্রামের রাস্তায় দেখা মিলল মধুর সঙ্গে। বিদায়ী পঞ্চায়েত সদস্য মধু টুডু। যিনি বিজেপির টিকিটে জিতে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। সাইকেল করে যাচ্ছিলেন। ডাক শুনে দাঁড়ালেন। ভোটের কথা উঠতেই মধুর মন্তব্য, “এলাকাবাসীকে বলছি ভোটটা সিপিএমকে দাও।” কেন? মধুর জবাব, “বিজেপি, তৃণমূল দু’টো দলই তো গ্রামের কোনও উন্নতি করতে পারল না। তাই বাসিন্দাদের বলছি, ভোট ভাগাভাগি না করে সিপিএমকে জেতাও। দেখো, যদি গ্রামের উন্নতি হয়।”
রাজনীতির কথায় চাপানউতোর আসে। সিপিএম যেমন দাবি করে, উন্নয়নের নামে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। আবার তৃণমূলের দাবি, উন্নয়ন হয়েছে তাঁদের আমলেই। বিজেপি মনে করে, তারাই ওখানে ফের জিতবে।
এই সব বাক্য বিনিময়ের মধ্যে ঢুকতে চান না ফুলমণি সরেন। শুধু বলেন, “ভোটটুকু ছাড়া আমাদের প্রতিবাদ জানানোর আর কিছুই তো নেই।”
কথার মাঝেই আকাশ ভেঙে নামল বৃষ্টি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy