আরাবুল ইসলাম। —ফাইল ছবি।
শুক্রবার ভাঙড়ের তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামকে সাসপেন্ড করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। আরাবুলের কাছে সাসপেনশন নতুন নয়। এর আগেও দল থেকে সাসপেন্ড হয়েছেন তিনি। কিন্তু আবার ফিরেও এসেছেন। সে যাত্রায় তাঁকে দলে ফেরাতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন কলকাতার তৎকালীন মেয়র তথা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়। আবার ভাঙড়ের রাজনীতিতে আরাবুল কোনও ‘চাপে’ পড়লে তাঁকে দলীয় নেতৃত্বের রোষানল থেকে রক্ষা করতেন দলের ‘ওজনদার’ নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি তখন তৃণমূলের মহাসচিবের পদ সামলানোর পাশাপাশি ছিলেন দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান। তিনিই আরাবুলকে ‘তাজা নেতা’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে, এই দুই নেতাই এখন রাজনীতির মূলস্রোত থেকে দূরে। তাই ‘অভিভাবকহীন’ আরাবুলের তৃণমূলে পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা প্রায় খারিজ করে দিচ্ছেন দলের নেতারাই।
২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বসিরহাটের তৃণমূল প্রার্থী সুজিত বসু ৫২ হাজার ভোটে পিছিয়ে গিয়েছিলেন ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্র (২০০৯ সালে আসন পুনর্বিন্যাসের আগে বসিরহাট লোকসভার অংশ ছিল ভাঙড়) থেকে। ২০০৬ সালে সেই আসনে জিতে তৃণমূল নেতৃত্বকে ‘অভয়’ দিয়েছিলেন আরাবুল। বামফ্রন্টের ২৩৫ আসন জয়ের ‘ঝড়ে’ যে ৩০টি আসন জিতে কোনওক্রমে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধীদল হয়েছিল তৃণমূল, তার একটি ছিল আরাবুলের ভাঙড়। ফলে তখন তৃণমূলে আরাবুলের আলাদা ‘কদর’ ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী দলনেতা করেছিলেন বেহালা পশ্চিম থেকে দ্বিতীয় বার বিধায়ক হওয়া পার্থকে। বিধানসভার সতীর্থ হওয়ার সুবাদেই ‘ঘনিষ্ঠ’ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল পার্থ-আরাবুলের। তখন দলের অভ্যন্তরে কোনও সমস্যা হলে আরাবুলের পাশে থাকতেন পার্থ।
কিন্তু ২০১১ সালে তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় এলেও ভাঙড়ে হারেন আরাবুল। ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে’ ওই বিধানসভা নির্বাচনে ভাঙড়ে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে যান তৃণমূল নেতা নান্নু হোসেন (গাজি)। ভোট কাটাকাটির অঙ্কে জয়ী হন সিপিএমের বাদল জমাদার। তবে হেরে গেলেও আরাবুলের মাথা থেকে পার্থের হাত সরেনি। ২০১৩ সালে পার্থ যখন প্রথম বার শিক্ষা দফতরের দায়িত্ব পান, প্রথম দিন পুষ্পস্তবক নিয়ে তাঁকে বিকাশ ভবনে স্বাগত জানাতে গিয়েছিলেন আরাবুল, যা নিয়ে সেই সময় বিতর্কও হয়েছিল। কিন্তু এখন পার্থ নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে জেলবন্দি। ২০২২ সালের ২৩ জুলাই এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) তাঁকে গ্রেফতার করার পরেই সরকারি সব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তৃণমূল থেকেও সাসপেন্ড করে হয়েছিল পার্থকে।
অন্য দিকে, ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতার মেয়র ও একাধিক মন্ত্রিত্ব ছেড়ে ‘স্বেচ্ছাবসরে’ চলে যান শোভন। ২০১৫ সালে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার কারণে আরাবুলকে তৃণমূল নেতৃত্ব ছ’বছরের জন্য সাসপেন্ড করার পরে তাঁর সাসপেনশন লাঘব করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন শোভন। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভাঙড়ে একটি জনসভা করে আরাবুলকে দলের মূলস্রোতে ফেরান শোভন। এখন শোভনও তৃণমূলের রাজনীতি থেকে দূরে।
গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে আরাবুলকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। গ্রেফতারের পর জামিন পেতে একাধিক বার আদালতে আবেদন করলেও তা মঞ্জুর হয়নি। তখন আইনজীবী ফিরোজ এডুলজির দ্বারস্থ হয় আরাবুলের পরিবার। তিনিই আদালতে কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে আরাবুলকে ‘মিথ্যা’ মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ করেন। যা ভাল চোখে দেখেনি তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। তাই জেলে থাকার সময় থেকেই আরাবুল এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে ‘দূরত্ব’ রচনা করেছিল তৃণমূল।
জামিন পাওয়ার পর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হিসেবে কাজে যোগ দেওয়ার জন্যও আরাবুলকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। গত বছর নভেম্বর মাসে কলকাতা হাইকোর্ট আরাবুলকে ভাঙড়-২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে সপ্তাহে দু’দিন করে যাওয়ার অনুমতি দেয়। আরাবুল সেই মতোই সেখানে যেতে শুরু করেন। সেটিও তৃণমূল নেতৃত্ব পছন্দ করেননি। বস্তুত, ২০১৬ সালের পর ভাঙড়ের রাজনীতির ‘রাশ’ চলে গিয়েছে সিপিএম থেকে তৃণমূলে আগত নেতা শওকত মোল্লার হাতে। ফলে আরাবুলের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ তৃণমূলে ছিলেন না। একপ্রকার বাধ্য হয়েই পুত্র হাকিমুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ভাঙড়ের রাজনীতিতে অধুনা ‘প্রাসঙ্গিক’ হওয়ার চেষ্টা করছিলেন আরাবুল। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সেই প্রচেষ্টায় ডায়মন্ড হারবার লোকসভা এলাকার এক সংখ্যালঘু তৃণমূল নেতা আড়াল থেকে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত আরাবুলকে সাপেন্ড করা হয়েছে ‘দলবিরোধী’ কাজের জন্য। তার পরদিনই তাঁর এবং তাঁর পুত্রের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে পুলিশে।
দলের কোনও ‘অভিভাবক’ নেই। তৃণমূলের মূলস্রোতে ‘তাজা নেতা’ সহায়হীন। ঘোর আতান্তরে আরাবুল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy