বৃষ্টির মধ্যে গার্ডেনরিচের দুর্ঘটনাস্থলে ত্রিপল খাটিয়ে চলছে উদ্ধারকাজ। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
একটা সিমেন্ট বাঁধানো চাতাল আর মসজিদ। তার দু’শো মিটারের মধ্যে গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাত-আটটি বাড়ি! গার্ডেনরিচের ফতেপুরে এই বাড়ির সারির মধ্যেই একটি ভেঙে পড়ে রবিবার রাতে। বুধবার সকালে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে সেই চাতালে দাঁড়িয়েই ভেঙে পড়া বহুতলের উদ্ধার কাজ দেখার ফাঁকে এক যুবক বললেন, ‘‘এই বাড়ির জঙ্গলের প্রোমোটার এক জনই।’’ এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, ওই এলাকায় যে বহুতলই হোক না কেন, তার প্রোমোটার মহম্মদ ওয়াসিম ওরফে ওয়াসি। শুধু সাব-প্রোমোটার হিসেবে কাগজে আলাদা আলাদা লোকের নাম থাকে।
ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরিতে সিন্ডিকেট রাজ পশ্চিমবঙ্গে নতুন শব্দ নয়। সিন্ডিকেটের দ্বৈরথও এ রাজ্য গত এক দশকে বারবার দেখেছে। রাজ্যের শাসক দলের নেতারাও যেমন প্রকাশ্যে সিন্ডিকেটের পাশে দাঁড়িয়েছেন। গার্ডেনরিচের ঘটনার পরে স্থানীয় কাউন্সিলর শামস ইকবাল বলছেন, ‘‘একটা বাড়ি ভেঙে পড়া বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কর্মহীন ছেলেরা নির্মাণ ব্যবসায় নেমেছে, তাতে খারাপ কী? সিন্ডিকেট মানেই কিন্তু খারাপ নয়।’’
গার্ডেনরিচ অবশ্য সিন্ডিকেটের দ্বৈরথ দেখেনি। স্থানীয়রা বলছেন, এখানে সবাই ওয়াসির ছাতার তলায় থাকতেন। তাই দ্বৈরথের প্রশ্ন নেই। তবে থাবা বাড়তে বাড়তে ফ্ল্যাট ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত বাড়িতেও পড়েছে। সিন্ডিকেট-নিয়ম না মানলে বাড়ি ওঠে না অথবা ঘাড়ে চাপে পুলিশি ঝক্কি।
দশ জনের মৃত্যুর পরে গার্ডেনরিচের ফতেপুরে নির্মাণ ব্যবসার সিন্ডিকেট ঘিরে নানা অভিযোগ সামনে আসছে। জানা যাচ্ছে, ভেঙে পড়া বাড়ির নীচ তলায় ছিল ওয়াসি-সিন্ডিকেটের অফিস ঘর। সিন্ডিকেটের মূল সদস্য আট জন। তাঁদের মধ্যে পরভেজ আহমেদ, শামিম শেখ এবং গুড্ডু নামের কয়েক জনের কথা স্থানীয়দের মুখে মুখে ঘুরছে। তাঁদের অধীনে রয়েছেন কয়েকশো যুবক। এই সিন্ডিকেটে ওয়াসির ‘সেনাপতি’ ছিলেন আব্দুল রউফ নিজামি ওরফে শেরু। ঘটনার পর থেকেই তিনি নিখোঁজ। পরিবারের দাবি, বাড়ি ভেঙে পড়ার সময় শেরু সিন্ডিকেটের ঘরে ছিলেন। হয়তো ধ্বংসস্তূপের তলায় আটকে আছেন।
ওয়াসির মাথায় কার হাত ছিল সে সব চর্চা তো গত ক’দিনে নানা মুখে ঘুরেছে। বাসিন্দারাও বলছেন, অত্যাচারিত হয়েও তাই এত দিন কেউ মুখ খোলেনি। এখন ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ওয়াসির নির্দেশে শেরুই মূলত ফাঁকা জমি চিহ্নিত করতেন। পুরনো বাড়ি দেখলেও পৌঁছে যেতেন সিন্ডিকেটের সদস্যেরা। চাপ দিয়ে কম দামে বাড়ি বিক্রি করিয়ে নেওয়া হত। তার পরে সেই বাড়িতে ‘আপন নিয়মে’ বহুতল তুলত ওয়াসি-বাহিনী। সেখানেই ‘সাব-প্রোমোটার’ হিসাবে কাজ করতেন পারভেজ, শামিম, গুড্ডুরা। ওয়াসির নির্দেশ মতোই লাভের লাড্ডুর ভাগ হত।
স্থানীয়দের অনেকেই বলছেন, লাভের লাড্ডু শুধু এলাকায় আটকে থাকত না। নেতা-দাদাদের হাত ধরে তা বহু দূরে পৌঁছে যেত। জায়গা বুঝে সেই ভাগ প্রতি বর্গফুটে ৪০০ টাকা থেকে শুরু হত। ভাল দাঁও মারতে পারলে বর্গফুটে হাজার টাকাও উঠত! কেউ যদি ভাবতেন, সোজা পথে পুরসভার অনুমতি নিয়ে বাড়ি করবেন তাতেও নিস্তার নেই। সিন্ডিকেটে ‘ফুল-মিষ্টি’ না পৌঁছে দিলে পদে পদে হেনস্থা। বাড়ি শেষ হলেও মিলত না জলের সংযোগ।
স্থানীয় এক ব্যক্তির দাবি, বহু বছর ধরে বর্জ্য ফেলে পাহাড়পুর, ফতেপুর এলাকার জলাজমি ভরাট হয়েছে। কিন্তু গত দশ বছরে সিন্ডিকেটের হাত ধরে এখানে বহুতল তৈরির রমরমা শুরু হলেও জমি শক্ত করে নেওয়ার চেষ্টা দেখা যায়নি। এক স্থানীয় বাসিন্দা দেখালেন, একটি ফাঁকা জমিতে জায়গায় জায়গায় মাটি খুঁড়ে মাটির চাড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এক ঝলক দেখলে মনে হয়, যেন কুয়ো খোঁড়া। ওই স্থানীয়ের মন্তব্য, “এই জমিতে বাড়ি তুলতে গেলে আলাদা করে মাটি ফেলা দরকার। কিন্তু অত টাকা খরচ করতে চান না সিন্ডিকেটের মাথারা। তাই কুয়োর মতো করে ঘিরে নেওয়া অংশেই কম খরচে এঁটেল মাটি ভরে নেওয়া হয়েছে। এরপর কয়েক বছরেই বাড়ি হেলে পড়লেও প্রোমোটার দায় নেবে না।”
ওই এলাকার আর এক বাসিন্দা বাস্তুবাড়ি সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কথায়, “নিজের বাড়ির সংস্কার করতে গিয়ে মাসের পর মাস ঘুরতে হয়েছে। শেষে নিজেরা পারব না বুঝে এলাকার ছেলেদের কাজ দিয়েছিলাম। দু’লক্ষ টাকার কাজে তিন লক্ষ ২০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এত বেশি কেন দিতে হবে প্রশ্ন করায় বলা হয়েছে, অতিরিক্ত টাকাটা নাকি ভোটের ফান্ড!” বাড়ির ছাদ ঢালাইয়ের আগে মোটরবাইক বাহিনী বাড়ি এসে শাসিয়ে গিয়েছিল এক প্রৌঢ়কে। তাঁর অভিযোগ, “পুলিশে ফোন করার পরে বাড়িতে ভাঙচুর হয়েছে। সিন্ডিকেটের কথামতো ইট, বালি, সিমেন্ট নিইনি বলে আজও ছাদ করা হয়নি।”
নির্মীয়মাণ বহুতল ধসে অনেক কিছু যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে গার্ডেনরিচে। তাই অনেকেই এখন ‘সাবধানী’। স্থানীয় প্রোমোটার শুভাশিস দত্তের মন্তব্য, “আমারও একটা বাড়ি হেলে পড়েছে। কিন্তু সকলে ভাল ভাবে কাজ করলে, আমিও করব। নিয়ম যেন সকলের জন্য এক হয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy