ইশিকা সাউ। নিজস্ব চিত্র।
আগামীর মুখ স্পর্ধিত চারাগাছের দল বা ভরসার শিকড় মহীরূহের মুখগুলি এ বারও দেখা গেল না সরাসরি। পর পর দু’বছর ‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সেলেন্স’ সম্পন্ন হল ভার্চুয়াল পরিসরেই। তবু নানা বাধা ঠেলে হার না-মানা সঙ্কল্পের আলোকশিখাগুলি সহজেই চিনে নেওয়া গিয়েছে।
এ বছরই অতিমারির ঝড়ঝাপটা যেন তীব্রতর। কোভিডের শিকার ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শিক্ষক, ছাত্রদের উৎসর্গ করেই শনিবার সকালে অনুষ্ঠান শুরু করেন সঞ্চালক ব্যারি ও’ব্রায়েন। বিশেষ করে চার শিক্ষাবিদ বরাহনগরের সেন্ট্রাল মডার্ন স্কুলের নবারুণ দে, ব্যারাকপুরের অ্যাসেম্বলি অব এঞ্জেলস স্কুলের এস এন জাকি, টেকনো ইন্ডিয়া স্কুলের সুজাতা ঘটক এবং চৌরঙ্গি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জনি দাসানিকে কোভিডে হারানোর রক্তাক্ত স্মৃতিই যেন মূল সুরটা বেঁধে দেয়।
এই দুঃসময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পগুলোও তাই অন্য মাত্রা পাচ্ছে। শিয়ালদহ লরেটো স্কুলের রেনবো হোম পিছিয়ে থাকা পড়ুয়াদের কাছছাড়া করেনি অনলাইন ক্লাসের দিনেও। পূর্ব বর্ধমানে সুদপুর হাইস্কুলের পড়ুয়ারা বেশিরভাগই পোটো বা কুমোরের ঘরের ছেলে। স্কুলের যামিনী রায় সংগ্রহশালা মেলে ধরছে তাদের শিল্পকর্ম বা সৃজনশীল প্রতিভার নানা স্বাক্ষর, যা জীবিকারও হদিশ দিচ্ছে। তাঁরা পেলেন ‘স্কুল দ্যাট কেয়ারেস’-এর স্বীকৃতি। একই ধাঁচের চেষ্টার শরিক এই আকালে মাথা তুলে দাঁড়ানো আরও অনেকেই। হিঙ্গলগঞ্জের কনকনগর এসডি ইনস্টিটিউশনের ছাত্রী, প্রাক্তনীদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী ‘মম’ও পোশাক, ব্যাগ তৈরির কাজে বিকল্প আয়ের দিশা খুঁজছে। হিউম্যানস অব পাটুলির স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষকদের রোকেয়া শিক্ষাকেন্দ্র দক্ষিণ কলকাতার উপান্তে স্কুলবিহীন স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে গড়ে তুলছে দায়বদ্ধতা। ছাত্র, শিক্ষকদের বোঝাপড়ায় যা একটি স্থায়ী সামাজিক মডেল হতে পারে। 'শুধু সুন্দরবন চর্চা' বলে একটি মঞ্চও অতিমারি-পর্বে ৩৫টি স্কুলের ৫০০০ পড়ুয়ার পাশে থেকেছে। শিলিগুড়ির ফাঁসিদেওয়ার মুরলীগঞ্জ হাই স্কুল এবং শ্রী শিক্ষায়তন স্কুলও পরিবেশবন্ধু ভূমিকার জন্য বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে।
খানাকুলে বন্যায় চার বার বইখাতা সব খুইয়েও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বাবার ও পরিচারিকা মায়ের মেয়ে ক্লাস টেনের অনন্যা সামন্ত হার মানেনি। জটিল ত্বকের রোগে মাসে বিপুল খরচ, তবু পড়াশোনা ছাড়েনি। এই মঞ্চে তারও পাশে থাকার শপথ উঠে এল। স্কুলে ভর্তির পোর্টাল এবিপি অ্যাডমিশনট্রি.কমের বৃত্তি পেয়েছে বজ্রাঘাতে নিহত ভাগচাষীর ছেলে পিংলার প্রীতম পাড়ই। ৯২% পেয়ে এগারো ক্লাসে ভর্তি হয়ে যার শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে। বীরভূমের অখ্যাত গ্রাম থেকে উঠে এসে ইস্টবেঙ্গল ও বাংলার জার্সি গায়ে চাপানো ১৭ ছুঁই ছুঁই সোনালি সোরেনও এই আসরের একটি বিশিষ্ট চরিত্র।
অতিমারি দিনের আপসোস থাকবে বৌবাজারের ফুটপাতের মেয়ে ইশিকা সাউকে এই মঞ্চে সশরীরে দেখা গেল না বলে! বাপহারা নবম শ্রেণির কিশোরী এ বছর রাষ্ট্রপুঞ্জের পার্লামেন্ট অব দ্য হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের শিশু নির্যাতন বিরোধী প্রচারের অন্যতম মুখ হিসেবেও পথশিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের মতো নানা বিষয় নিয়ে ইশিকা সরব। এমন নানা রূপকথা বছর বছর নতুন হয়ে ধরা পড়ে এই মঞ্চে। কোভিডে একলা মায়ের মেয়ে দুর্গাপুরের রিচা চৌবে মাকে হারিয়েছেন। বারো ক্লাসের পরীক্ষায় ভাল ফল করে তবু তিনিও জীবনের কাছে হারতে নারাজ। স্কেটিং বিশারদ কন্যা মুশাম্মদ জাহেরিনের দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধের গল্পও উঠে এল। কিংবা আজন্ম জটিল স্নায়ুরোগকে টক্কর দিয়ে সল্টলেকের অমিতায়ু সেনের বারো ক্লাসের সিবিএসই পরীক্ষায় যুদ্ধজয়ের গল্প।
পুরুলিয়ার সৈনিক স্কুলের ছাত্র ক্যাডেট অমিত রাজ বিহারের গ্রামে গত বছর আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পড়শি দু’টি বাচ্চাকে বাঁচায়। কিন্তু নিজে বাঁচতে পারেনি। সেই আত্মবলিদানকেও কুর্নিশ জানানো হল।
এ দিন সম্মানিত শিক্ষকদের পথ চলাও অবশ্য পড়ুয়াদের তুলনায় কম রোমাঞ্চকর নয়। শোনা গেল, টিকিয়াপাড়ার মামুন আখতারের কথা। গরিব বাবার অপারগতার জন্য ক্লাস সেভেনে স্কুল থেকে বিতাড়িত কিশোরই আজ রেললাইন লাগোয়া বস্তি তল্লাটের ঘরে ঘরে শিক্ষার খিদে জাগিয়ে তুলেছেন। আগে নিজের চিলতে ঘরে ছক-ভাঙা স্কুলছুটদের স্কুল চালাতেন। তিনি এখন একই সঙ্গে তিনতলা স্বপ্নের ইস্কুলবাড়ি সত্যি করে দেখিয়েছেন। বালিগঞ্জ শিক্ষাসদনের মার্শাল আর্টস শিক্ষক অশোক সিংহ, দার্জিলিংয়ের ক্যামেলিয়া স্কুলের শডেন থিনলে, কেসি নাগকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাতা মিত্র ইনস্টিটিউশনের ইনাম হোসেন বা ময়দানের ক্রিকেট শিক্ষক তুলসীদাস মুখোপাধ্যায়ের মতো কেউ কেউও এক বন্ধনীতে ঠাঁই পেয়েছেন। অতিমারির বিচ্ছিন্নতার দিনেও এমন অনুষ্ঠানই বলতে পারে, ‘ভরসা যেন পড়ায়, আর ভরসা যেন পড়তে আসে’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy