উত্তপ্ত : বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে গাড়ি। বৃহস্পতিবার দার্জিলিঙে। ছবি: এএফপি।
সকাল থেকেই মেঘ জমে ছিল দার্জিলিঙের আকাশে। তার মধ্যেই ভিড় বাড়ছিল ব্যাঙ্কে। হঠাৎই খবর ছড়িয়ে পড়ে, বিশাল পুলিশ বাহিনী ঘিরে ফেলেছে সিংমারিতে মোর্চার দফতর। সঙ্গে সঙ্গেই সাত দিন আগের বৃহস্পতিবারের কথা মনে পড়ে যায় দার্জিলিঙের। চকবাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকা ফাঁকা হয়ে যেতে শুরু করে।
তারপর থেকে চড়চড় করে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কাঁদানে গ্যাস, গাড়ি জ্বালানো, ইট বৃষ্টি, অনির্দিষ্টকালের বন্ধের ডাকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দার্জিলিঙের জনজীবন।
এ দিন বন্ধের মধ্যে ব্যাঙ্কে খোলার ছাড়ের দিন ছিল। তাই নানা শাখায় ভিড়ও ছিল। তার মধ্যেই মোর্চার মিছিলের প্রস্তুতি চলছিল সিংমারিতেও। সেখানে জেলা পুলিশ সুপার অখিলেশ চতুর্বেদীর নেতৃত্বে পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা পার্টি অফিস ঘিরে ফেলায় প্রথমে কিছুটা হকচকিয়ে যান মোর্চা কর্মী-সমর্থকরা। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে চলে আসেন পাহাড়ের দায়িত্বে থাকা তিন আইপিএস অফিসার সিদ্ধিনাথ গুপ্ত, জাভেদ শামিম এবং অজয় নন্দ। হঠাৎই সিংমারি থেকে পুলিশ বাহিনী এগোতে শুরু করে পাতলেবাসের দিকে। সেখানেই বাড়ি মোর্চা প্রধান বিমল গুরুঙ্গের। সিংমারির দিকে পুলিশ বাহিনীকে যেতে দেখে চোখে মুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে মোর্চা কর্মীদের। মোবাইল নিয়ে ঘন ঘন খবর চালাচালি করতে দেখা যায় কয়েক জন মোর্চা নেতাকেও।
বিধ্বংসী: তিনধারিয়ার কাছে ৫৫নং জাতীয় সড়কে জ্বলছে এনবিএসটিসির বাস। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র।
এর পরেই অনির্দিষ্টকালের বন্ধের ডাক দেয় মোর্চা। দলের সহ সম্পাদক বিনয় তামাঙ্গ ঘোষণা করেন, ‘‘এখন থেকেই অনির্দিষ্ট কালের বন্ধ শুরু।’’ শহর জুড়ে শুরু হয় চাঞ্চল্য।
নিশানা: পাতলেবাসে মোর্চার দফতর থেকে পাওয়া গিয়েছে এই অত্যাধুনিক ধনুক। তা হাতে নিয়ে পরখ করে দেখছেন
পুলিশ আধিকারিক অজয় নন্দ। বাঁ দিকে আর এক আইপিএস সিদ্ধিনাথ গুপ্ত। ছবি: এএফপি।
সিংমারিতে তখনও উত্তেজনা চরমে। পুলিশ দাবি করে, বিমল গুরুঙ্গ বাড়ি ছেড়ে পিছনের জঙ্গল দিয়ে কোনও গোপন ডেরায় চলে গিয়েছেন। হঠাৎই জ্বলতে দেখা যায় সংবাদমাধ্যমের একটি গাড়ি। পুলিশ ঢুকে পড়ে গুরুঙ্গের বাড়িতে।
শহরের মেজাজও ততক্ষণে বদলে গিয়েছে। সকালে দোকানপাট কিছু খুলেছিল। তা-ও সে সময়ে বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ গুরুঙ্গের বাড়ির দিকে এগোচ্ছে শুনেই শহরের রাস্তাও ফাঁকা হতে শুরু করে দিয়েছিল।
ম্যালের আস্তাবল থেকে আজ ঘোড়া বার হয়নি। চলেনি চৌরাস্তার জায়ান্ট স্ক্রিন। পুণের বাসিন্দা জয়প্রকাশ শাহর মতো মাত্র কয়েক জনই ছিলেন ম্যালে। দুপুরে জয়প্রকাশবাবু বলেন, ‘‘ছবিতে ম্যাল দেখেছি। এমন নয়। কিন্তু কী করব? পরিস্থিতিই এমন।’’ তবে গত কয়েক দিন পাহাড় প্রায় পর্যটক শূন্য। বড় বড় হোটেলে দু’টি বা তিনটি ঘরে কেবল লোক রয়েছেন। তা-ও যাঁরা কাজে এসেছেন দার্জিলিঙে, তাঁরাই। গাঁধী রোড, লেবং কার্ট রোড, ক্লাব সাইড রোড, এইচডি লামা রোডের রাস্তা সারা দিন ফাঁকা। সদর থানা ও জেলা হাসপাতালের সামনে গুটিকয়েক হোটেল এবং ওষুধের দোকান খোলা।
অথচ বেলা ১১ পর্যন্ত ছিল ছবিটা অন্যরকম। রাস্তায় লোক ছিলেন। দুপুরে পরিস্থিতির পরিবর্তনের পরে সুনসান হয়ে যায় এলাকা। চকবাজারে ফুটবল খেলছিলেন কয়েক জন। দূরে বসে সিআরপিএফের তিন জওয়ান তা দেখছিলেন। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কাকঝোরের বাসিন্দা প্রবীণ বিশ্বকর্মা চোখ কুঁচকে বললেন, ‘‘দুপুরে চকবাজার এত সুনসান যে, সুপার মার্কেটের সামনে ফুটবল খেলা হচ্ছে—এমনটা শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ে না। দুপুরে এখানে দাঁড়ানোর জায়গা মেলে না।’’
সন্ধ্যা ৬টায় দার্জিলিঙের রাস্তা দেখে মনে হতে পারে রাত দু’টো। কনকনে ঠান্ডা। রাস্তায় পুলিশ আর সিআরপিএফ। কুকুর ডাকছে। রাস্তায় একটি দু’টি গাড়ি চালক বা হোটেলকর্মী বসে গল্প করছেন। দুই আনাজ বিক্রেতা মাথায় রাইশাক আর মুলো নিয়ে কাকঝোরার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তারা বললেন, ‘‘বন্ধ ক’দিন চলবে কে জানে। গ্রাম থেকে আনাজ আনলাম সন্ধ্যায়। দ্বিগুণ দামে সব বিক্রি হচ্ছে। বাজার বন্ধ। রাস্তার ধারে বসে সকালে বিক্রি করে দেব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy