The rise of Abhishek Banerjee, the prince of TMC dgtl
Abhishek Banerjee
দিল্লির এমবিএ ছাত্র থেকে পরিণত রাজনীতিক, ১০ বছরে অভিষেকের আশ্চর্য উত্থান
বিধানসভা ভোটে জয়ের পর দলে অভিষেকের জন্য যে বড় ধরনের পদোন্নতি অপেক্ষা করছে, সে ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত ছিল তৃণমূলের অন্দরমহল।
নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতাশেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২১ ১৫:৪২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৬
খাতায়কলমে না হলেও তিনিই ছিলেন তৃণমূলের দ্বিতীয় শীর্ষ পদাধিকারী। তবে শনিবার আক্ষরিক অর্থেই দলের দু’নম্বর পদে বসলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হলেন তিনি। তৃণমূলে এখন অভিষেকের মাথার উপর শুধুই একজন— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
০২১৬
২০২১-এর বিধানসভা ভোট পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অভিষেককে সেই অধ্যায়ের সফল উপসংহারের অন্যতম লেখক বলা যায়। মমতার পর তিনিই ছিলেন দলের দ্বিতীয় তারকা প্রচারক। জেলায় জেলায় ঘুরে প্রচার করেছেন। ভোটকৌশলী প্রশান্ত কিশোরকে দলের নিয়ে আসার সিদ্ধান্তও ছিল তাঁরই। তাঁর সেই পরিশ্রম এবং সিদ্ধান্তের ফল পেয়েছে তৃণমূল। তাই জয়ের পর দলে অভিষেকের জন্য যে বড় ধরনের পদোন্নতি অপেক্ষা করছে, সে ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত ছিল তৃণমূলের অন্দরমহল। যদিও সেই পদোন্নতি ঠিক কীরকম বা কতটা, সে ব্যাপারে ধারণা ছিল না কারও। শনিবার তৃণমূলের যুবনেতার পদ থেকে সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতে পদার্পণ করলেন তিনি।
০৩১৬
বয়স ৩৩। অথচ এরই মধ্যে রাজ্য রাজনীতি ছেড়ে জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে ঢুকে পড়লেন তৃণমূলের দু’বারের সাংসদ অভিষেক। নতুন দায়িত্ব বলছে, আপাতত তাঁর লক্ষ্য একটাই— ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন। জাতীয় রাজনীতিতে মোদী-বিরোধী প্রধান বিরোধী মুখ হিসেবে ক্রমশই প্রকট হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। অভিষেকের দায়িত্ব, জাতীয় স্তরে বিভিন্ন রাজ্যে তৃণমূলের ভিত প্রতিষ্ঠা করার। মমতার বার্তা অন্তত ১০টি রাজ্যে পৌঁছে দেওয়ার।
০৪১৬
ঠিক ১০ বছর আগে রাজনীতিতে আসা যুবকের এই রাজনৈতিক উত্থান চোখে পড়ার মতোই। যদিও অভিষেকের সমালোচকরা মনে করতেন, সাফল্য তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। মমতার জনপ্রিয়তা আর তৃণমূলের অন্য নেতাদের পরিশ্রমকে সহজ ভিত্তি হিসেবে পেয়েছেন অভিষেক। তবে সেই সমালোচনা সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা ভোটে সপাটে মাঠের বাইরে ফেলেছেন তিনি। বিধানসভা ভোটে একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সরাসরি মোকাবিলা করেছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির। পরিণত রাজনীতিকের মতো ব্যবহার করেছেন। বক্তৃতা করেছেন তুখড়।
০৫১৬
১৯৮৭ সালের ৭ নভেম্বর কলকাতায় জন্ম অভিষেকের। বাবা অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়, মা লতা। মমতার আট ভাইপো-ভাইঝির মধ্যে সবচেয়ে বড় তিনিই। পড়াশোনা প্রথমে নব নালন্দা হাইস্কুলে। পরে কলকাতারই এম পি বিড়লা ফাউন্ডেশন হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে দ্বাদশ উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর মানব সম্পদ এবং বিপণন সংক্রান্ত পড়াশোনা করতে দিল্লি চলে আসেন। ২০০৯ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট থেকে এমবিএ করেন অভিষেক। তার পরেও দিল্লিতেই ছিলেন। ২০১১ সালে তাঁকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনেন মমতা।
০৬১৬
২০১১ সালও ছিল তৃণমূলের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। সে বছরই পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের বামশাসনকে উপড়ে ফেলে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল। মমতা অভিষেকের রাজনৈতিক অভিষেক সে বছরেই। তৃণমূলের যুবশাখার নেতা হিসেবে রাজনৈতির যাত্রা শুরু হয়েছিল অভিষেকের। তৃণমূল যুব কংগ্রেস থাকা সত্ত্বেও তৈরি হয়েছিল ‘তৃণমূল যুবা’ নামে দলের একটি নতুন যুব শাখা। তার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন অভিষেক।
০৭১৬
ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না অভিষেকের। কলেজ জীবনে তো নয়ই, এমনকি, ২০০৬-’০৭ সালে মমতার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনেও কোনও ‘সক্রিয়’ ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি অভিষেককে। ধর্মতলায় মমতার অনশনে কিংবা সিঙ্গুরের মঞ্চে অবশ্য কয়েকবার দেখা গিয়েছিল তাঁকে। তবে কোনও জনসভায় তাঁকে বক্তৃতা দিতে দেখা যায়নি। এমনকি, কোনও জনসভার আয়োজন করতেও দেখা যায়নি। মমতার নন্দীগ্রাম আন্দোলনের ‘মুখ’ তখন তৃণমূলের তৎকালীন যুবনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
০৮১৬
মমতার তৎকালীন আস্থাভাজন নেতা, দলের সেই সময়ের দু’নম্বর মুকুল রায়ের পরামর্শেই ‘তৃণমূল যুবা’ তৈরি করেন মমতা। তার সভাপতি পদে বসান অভিষেককে। তৃণমূলের ‘কর্পোরেট মুখ’ হিসেবে যাত্রা শুরু করে অভিষেকের ‘যুবা’। ৩০ টাকার বিনিময়ে সদস্যপদের পাশাপাশি দেওয়া হত টুপি, টি-শার্ট, মাথায় বাঁধার ব্যান্ডানা এবং ব্যানার। সব কিছুতেই লেখা ‘যুবা’। বাজার ছেয়ে যায় সেই সব প্রচার-পণ্যে। হোর্ডিংয়ে ব্যানারেও বিপুল জনপ্রিয়তা পায় ‘যুবা’। শুধু সদস্যপদ আর প্রচারপণ্য থেকে ২৮ কোটি টাকা তুলেছিল যুবা। তবে মূল ধারার রাজনৈতিক স্রোতে ‘তৃণমূল যুবা’ বড় একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি বলেই মনে করনে তৃণমূল নেতাদের একাংশ।
০৯১৬
অভিষেক অবশ্য হাল ছাড়েননি। মমতার ছত্রছায়ায় ধীরে ধীরে রাজনীতির পাঠ শুরু করেন। সেই প্রক্রিয়াকে কিছুটা এগিয়ে দেয় সোমেন মিত্রের সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্বের রাজনৈতিক বিরোধ। ২০১৪ সালে তৃণমূল ছেড়ে বেরিয়ে যান সোমেন। ফলে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মণ্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থীর প্রয়োজন হয়। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সির মতো নেতারা অভিষেককে বলেন সোমেনের কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে।
১০১৬
মাত্র ২৬ বছর বয়সে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ডায়মণ্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হন অভিষেক। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় তখন পার্টি মেশিনারির দায়িত্বে শোভন চট্টোপাধ্যায়। সেখানে রীতিমতো পোক্ত ভিত তাঁর। অভিষেককে জেতাতে পুরোদমে মাঠে নামেন শোভন। ফলও মেলে। সিপিআইএম-এর আব্দুল হাসনত খানকে হারিয়ে লোকসভার কনিষ্ঠতম সাংসদ হন অভিষেক।
১১১৬
সেই শুরু। তার পর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি অভিষেককে। দলে শুধুই উত্থান হয়েছে তাঁর। এরই মধ্যে কলেজজীবনের প্রেমিকা রুজিরাকে বিয়ে করেন অভিষেক। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে হয়েছিল সেই বিয়ের অনুষ্ঠান।
১২১৬
২০১৩ সালের অভিষেক-রুজিরার প্রথম সন্তান, কন্যা আজানিয়ার জন্ম। নাম রেখেছিলেন মমতা নিজেই। ঘনিষ্ঠ মহলে মমতা বলেওছিলেন, আজানিয়ার মধ্যে তাঁর মা গায়ত্রী দেবীই ফিরে এসেছেন। সাংসদ হয়ে ধীরে ধীরে রাজনীতিতে দড় হতে শুরু করেন অভিষেক।
১৩১৬
ততদিনে ‘তৃণমূল যুবা’ মিশে গিয়েছে যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে। যুব তৃণমূলের নেতৃত্বে এসেছেন অভিষেক। দলের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে প্রথম সারির তৃণমূল নেতাদের পাশাপাশি দেখা যেতে থাকে তাঁকে। দলের অন্দরে বাড়তে শুরু করে তাঁর প্রভাব।
১৪১৬
তবে প্রভাব, পদ, প্রতিপত্তির হাত ধরেই আসে অসূয়া। মমতার ভাইপো অভিষেকের উত্থান নিয়ে তাই দলের অন্দরে আড়ালে-আবডালে পরিবারতন্ত্রের প্রসঙ্গ টেনে সমালোচনা শুরু হয়। তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতারও তখন মনে মনে অভিষেককে মেনে নিতে কষ্ট হতে শুরু করেছে। তাঁদের মধ্যে এক নম্বরে মুকুল রায়।
১৫১৬
২০১৭ সালে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দেন মুকুল। পরের বছর, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয় অভিষেককে। কিছু কিছু জেলায় বিরোধীদের প্রার্থী দিতে না দেওয়ার অভিযোগ ছিল। কিন্তু বিপুল ভোটে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতে তৃণমূল।
১৬১৬
দলের অঘোষিত দু’নম্বর হিসেবে অভিষেকের আত্মপ্রকাশ ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের পর। ওই ভোটে বিজেপি-র উত্থানের পর ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে সতর্ক হয় তৃণমূল। ভোটকৌশলী প্রশান্ত কিশোরকে নিয়ে আসেন অভিষেক। অভিষেক-পিকে জুটিই ছিল ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের অন্যতম চালিকাশক্তি। টানা পরিশ্রম করেন অভিষেক। প্রাথী নির্বাচনেও তাঁর ভূমিকা ছিল বড়সড়। মূলত মমতা এবং অভিষেকের উপর ভর করেই বিজেপি-কে পর্যুদস্ত করে তৃণমূল। অতঃপর দলের মূল সংগঠনে মমতার পরেই সর্বোচ্চ পদে বসানো হয়েছে অভিষেককে। তৃণমূলে একদা তাঁর সমালোচকরাও মেনে নিচ্ছেন, এই দায়িত্ব এবং সম্মান অভিষেকের প্রাপ্যই ছিল।