Pakistan Afghanistan Conflict Islamabad conducts airstrike in Taliban state know the reasons dgtl
Pakistan Afghanistan Conflict
হিন্দুকুশের উপত্যকায় আগুন ঝরাল পাকিস্তান, উচিত শিক্ষা দেবে তালিবান? কী নিয়ে বিবাদে দুই দেশ?
আফগানিস্তানে ঢুকে বিমানহানা চালিয়েছে পাক বায়ুসেনা। পাল্টা প্রত্যাঘাতের হুঁশিয়ারি দিয়েছে কাবুলের তালিবান সরকার। আগামী দিনে বড় সংঘর্ষে জড়াবে দুই দেশ?
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৫:৪৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২১
বড়দিনে শুধুই বারুদের গন্ধ। ফের রক্তাক্ত হল হিন্দুকুশের উপত্যকা। সেখানে এ বার আকাশপথে হামলা চালিয়েছে ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী। ফলে আমু দরিয়ার তীরে বেজে উঠেছে রণডঙ্কা। প্রতিশোধের আগুনে পোড়া স্বাধীনচেতা আফগানেরা প্রত্যাঘাত শানালে পরিস্থিতি যে জটিল হবে, তা বলাই বাহুল্য।
০২২১
চলতি বছরে যিশু-দিবসের ঠিক আগের রাতে (পড়ুন ২৪ ডিসেম্বর) আফগানিস্তানে বিমানহানা চালায় পাকিস্তানের বায়ুসেনা। কাবুলভিত্তিক সংবাদ সংস্থা ‘খামা প্রেস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামলা হয়েছে বারমাল জেলার পাকতিকা প্রদেশে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৫ জন স্থানীয় আফগান নাগরিক।
০৩২১
চলতি বছরের মার্চে হিন্দুকুশের কোলে একই রকমের আক্রমণ শানিয়েছিল পাক বায়ুসেনা। ন’মাসের মধ্যে ফের এক বার আগ্রাসী মনোভাব দেখাল ইসলামাবাদ। যদিও সরকারি ভাবে পাকতিকার বিমানহানা নিয়ে কোনও বিবৃতি দেয়নি রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর।
০৪২১
কেন বার বার ‘নিরীহ’ আফগানদের নিশানা করছেন পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিফ মুনির? প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কথায়, এর নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। গত কয়েক মাসে পাকিস্তানের পশ্চিম প্রান্তের প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়ায় লাগাতার সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন একগুচ্ছ পাক সেনা অফিসার ও সৈনিক।
০৫২১
রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতরের অভিযোগ, খাইবার-পাখতুনখোয়ার ওই সমস্ত আক্রমণের নেপথ্যে হাত রয়েছে ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ বা টিটিপি জঙ্গি গোষ্ঠীর। কাবুলের তালিবান সরকার সরাসরি সাহায্য করছে তাঁদের। দিচ্ছে আশ্রয় এবং হাতিয়ার। ফলে পাকিস্তানে নাশকতার পর সীমান্ত টপকে আফগানিস্তানে আশ্রয় নিচ্ছে টিটিপি সন্ত্রাসীরা।
০৬২১
আর তাই গোয়েন্দা সূত্রে এই জঙ্গিদের গোপন আস্তানার হদিস মিলতেই সেখানে বিমানহানার নির্দেশ দিতে কালবিলম্ব করেননি জেনারেল মুনির। বিখ্যাত আমেরিকান সংস্থা লকহিড মার্টিনের তৈরি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান এই হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
০৭২১
খামা প্রেস জানিয়েছে, ‘‘ওই এলাকার লামান-সহ মোট সাতটি গ্রামের উপর আকাশপথে নেমে এসেছে আক্রমণ। পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বারমালের মুর্গ বাজার গ্রাম। নিহতের তালিকায় একটি পরিবারের পাঁচ সদস্য রয়েছেন।’’
০৮২১
জেনারেল মুনিরের দফতর সূত্রে খবর, বিমানহানায় কেবলমাত্র টিটিপির গুপ্ত আস্তানাগুলিকে নিশানা করা হয়েছে। কোনও নিরীহ নাগরিকের হত্যা এর উদ্দেশ্য নয়। আফগানিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসবাদীদের কোমর ভাঙতে এই ধরনের আরও আক্রমণ চালানোর ইঙ্গিত দিয়েছে রাওয়ালপিন্ডি।
০৯২১
পাক বায়ুসেনার পদস্থ অফিসারদের দাবি, এই হামলায় একাধিক টিটিপি জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে। ওড়ানো গিয়েছে তাদের প্রশিক্ষণ শিবির। তবে বড় মাপের কোনও সন্ত্রাসী নেতার মৃত্যু হয়েছে কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।
১০২১
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আগেই ‘দোহা চুক্তি’ সেরে রেখেছিল তালিবান। সেই মতো দ্বিতীয় বারের জন্য কাবুলের তখ্তে বসে এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। তার পর থেকেই কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে ইসলামাবাদের।
১১২১
উনিশ শতকে আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত নির্ধারণকারী রেখা তৈরি করেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পদস্থ আধিকারিক হেনরি মর্টিমার ডুরান্ড। তাঁর নামানুসারে সেটি পরিচিতি পায় ‘ডুরান্ড লাইন’ হিসাবে। ২,৬৭০ কিলোমিটার লম্বা রেখাটির জন্মসাল ছিল ১৮৯৩।
১২২১
কিন্তু, প্রথম দিন থেকেই ডুরান্ড লাইন মেনে নেননি আফগানিস্তানের শাসকেরা। আন্তর্জাতিক সীমান্ত নির্ধারণকারী এই রেখাটির দু’ধারেই রয়েছে পাশতুন জনজাতির বাস। আমু দরিয়ার তীরের দেশটিতে এঁরাই সংখ্যাগুরু। ফলে ডুরান্ড লাইন পেরিয়ে পাকিস্তানের অটক শহর পর্যন্ত জমিকে নিজেদের এলাকা বলে মনে করে কাবুল।
১৩২১
কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশভাগের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া পাকিস্তান আবার ১৯৪৭ সাল থেকে ডুরান্ড লাইনকেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসাবে মান্যতা দিয়ে এসেছে। তালিবান দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর ওই রেখা বরাবর কাঁটাতারের বেড়া বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় ইসলামাবাদ। আর এই নিয়ে কাবুলের সঙ্গে শুরু হয় সীমান্ত সংঘর্ষ।
১৪২১
এই পরিস্থিতিতে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো সামনে চলে আসে টিটিপি। খাইবার পাখতুনখোয়ায় স্বাধীন ‘পাশতুনিস্তান’ তৈরির দাবিতে পাক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ শানাতে শুরু করে তারা। অভিযোগ, পর্দার আড়ালে থেকে তাদের ক্রমাগত মদত দিয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তানের তালিবান সরকার। বিশেষজ্ঞদের কথায়, ডুরান্ড লাইন থেকে পাক ফৌজকে তাড়িয়ে অটকের ও পারে পাঠাতে চায় তারা।
১৫২১
১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ করে রাশিয়া। যুদ্ধ বাধতেই শয়ে শয়ে আফগান নাগরিক সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নেন পাকিস্তানে। কাবুল দখলের জেরে মধ্য এশিয়ায় কয়েক গুণ বেড়ে যায় মস্কোর প্রভাব। ফলে প্রমাদ গোনে আমেরিকা।
১৬২১
আফগানিস্তানকে রাশিয়ার কবল মুক্ত করতে পাকিস্তানের সাহায্য নেয় ওয়াশিংটন। ইসলামাবাদের সাহায্যে আফগান শরণার্থীদের একাংশকে ‘মুজ়াহিদিন’ বা ধর্মযোদ্ধা হিসাবে গড়ে তোলে যুক্তরাষ্ট্র। তাঁদের হাতে তুলে দেয় হাতিয়ার। মস্কোর বিরুদ্ধে হিন্দুকুশের পাহাড়ে লুকিয়ে গেরিলা লড়াইয়ে নামেন তাঁরা।
১৭২১
জ়িয়া-উল-হক থেকে শুরু করে পারভেজ় মুশারফ। পরবর্তী দশকগুলিতে একের পর এক পাক সেনাশাসক আফগান শরণার্থীদের মুজ়াহিদিন হিসাবে ব্যবহার করে গিয়েছেন। বিনিময়ে আমেরিকার থেকে মোটা অঙ্কের ডলার পকেট ভরেছেন তাঁরা। কিন্তু দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে আফগান শরণার্থীদের ঢল নামায় ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে পাক অর্থনীতি।
১৮২১
সম্প্রতি, এই আফগান শরণার্থীদের নিয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাহবাজ় শরিফ সরকার। তল্পিতল্পা-সহ তাঁদের দেশে ফেরত পাঠানোর কথা ঘোষণা করেছে ইসলামাবাদ। এতে বেজায় চটেছে কাবুলের তালিবান সরকার। কাজ ফুরিয়ে যাওয়ায় আফগান শরণার্থীদের ‘আস্তাকুঁড়ে’ ছুড়ে ফেলার নীতিতে প্রবল আপত্তি রয়েছে তাঁদের।
১৯২১
কাবুলের ওই আপত্তি সত্ত্বেও নিজেদের অবস্থানে অটল রয়েছে ইসলামাবাদ। মোট ৪০ লক্ষ আফগান শরণার্থীকে সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশে পাঠানো শুরু করে দিয়েছে শরিফ সরকার। পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসাবে আফগানিস্তানের সঙ্গে বেড়েছে সীমান্ত সংঘর্ষ। পাক ফৌজিদের উপর আক্রমণের সংখ্যা বাড়িয়েছে টিটিপি।
২০২১
২০২২ সালে টিটিপি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে প্রায় একতরফা ভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে পাক সেনা। তার পরও তাদের আক্রমণ বন্ধ হয়নি। রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর সূত্রে খবর, এই পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে ঢুকে বিমানহানা ছাড়া অন্য রাস্তা খোলা ছিল না। একরকম বাধ্য হয়েই করতে হয়েছে কঠোর পদক্ষেপ।
২১২১
অন্য দিকে এই বিষয়ে মুখ খুলেছে তালিবানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। সেখান থেকে জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়, এমন কোনও কাজ বরদাস্ত করা হবে না। পাক বায়ুসেনা নিরীহ শরণার্থীদের নিশানা করেছে। ইসলামাবাদকে এর ফল ভোগ করতে হবে।’’