Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
WB Panchayat Election 2023

পঞ্চায়েত ভোটে নাটকীয় অনিশ্চয়তা! কমিশনার রাজীবকেই সরিয়ে দিতে উদ্যোগী রাজ্যপাল বোস

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, রাজ্যপাল যা-ই করুন না কেন, কোনও অবস্থাতেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে রাজীবকে তাঁর পক্ষে সরানো সম্ভব নয়।

CV Ananda Bose and Rajiva Sinha.

(বাঁ দিকে) রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২৩ ০০:০৯
Share: Save:

পঞ্চায়েত ভোটের রাজনীতি এবং প্রশাসনকে ঘিরে এক দিনে একাধিক নাটকীয় পরিস্থিতি। বুধবার সন্ধ্যায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে নানা প্রশ্নের মুখে ফেলার পর দ্রুত ৮০০ কোম্পানির বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহের যোগদান রিপোর্ট (জয়েনিং রিপোর্ট) ফেরত পাঠিয়ে দিলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। কমিশনার পদে রাজ্যপাল ছাড়পত্র দেওয়ার পরেই নবান্ন রাজীবকে কমিশনার পদে বসিয়েছিল। এর পর রাজীবের যোগদান রিপোর্ট যায় রাজভবনে। কিন্তু সই না করেই তা ফেরত পাঠিয়ে দিলেন বোস। ঘটনাচক্রে, বুধবারই কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম তাঁর পর্যবেক্ষণে জানিয়েছেন, আদালতের কেন্দ্রীয় বাহিনী সংক্রান্ত নির্দেশ পালন করতে না চাইলে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজ্যপালের কাছে গিয়ে ইস্তফা দিতে পারেন। তার পরেই রাতে জানা গেল, রাজীবের যোগদান রিপোর্ট ফেরত পাঠিয়েছেন রাজ্যপাল। প্রশ্ন উঠেছে, এর পরেও কি কমিশনার পদে থাকতে পারবেন রাজীব? পঞ্চায়েত ভোটে কি অনিশ্চয়তা দেখা দিল? যদিও ভোটপ্রক্রিয়ায়— মনোনয়ন জমা দেওয়া, তা প্রত্যাহার করা, এ সব পর্ব পেরিয়ে ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা প্রকাশ করে ফেলেছে রাজীবের কমিশন।

মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর্বে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় হিংসার ঘটনা ঘটে। সেই আবহে গত শনিবার রাজীবকে রাজভবনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন রাজ্যপাল বোস। কিন্তু ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে সে দিন যাননি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার। রাজ্যপালের ডাকে সাড়া না দেওয়াতেই কি যোগদান রিপোর্ট ফেরত পাঠানো হল? জল্পনা তৈরি হয়েছে। তবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে এক জনের নামে অনুমোদন দেওয়ার পরেও তাঁর যোগদান রিপোর্ট এ ভাবে ফেরত পাঠানোকে ‘নজিরবিহীন’ বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহালদের একাংশ। সংবিধান বিশেষজ্ঞদেরও একাংশের মত, অনুমোদন দেওয়ার পর এ ভাবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে সরাতে পারেন না রাজ্যপাল। সন্দিহান রাজনৈতিক দলগুলিও।

রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে নবান্নের দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত আগেই মিলেছিল। রাজীবের পূর্ববর্তী কমিশনার সৌরভ দাসের কার্যকাল শেষ হয় গত ২৮ মে। তার পরে নতুন কমিশনার বাছাই ঘিরে টানাপড়েনের জেরে বেশ কয়েক দিন ওই পদটি ফাঁকাই পড়ে ছিল। ওই পদে রাজ্য সরকারের মনোনীত নামে রাজভবন ছা়ড়পত্র না-দেওয়ায় জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চায়েত ভোট নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছিল না, রাজ্যে কবে পঞ্চায়েত ভোট হবে! নতুন কমিশনার হিসাবে রাজীবের নাম প্রস্তাব করে ১৮ মে রাজ্যপালের অনুমোদনের জন্য ফাইল পাঠায় নবান্ন। একক নামে ছাড়়পত্র দিতে আপত্তি তুলে নবান্নের কাছে আরও একটি নাম চেয়ে পাঠায় রাজভবন। দ্বিতীয় নাম হিসাবে রাজ্যে কর্মরত অতিরিক্ত মুখ্যসচিব অজিতরঞ্জন বর্ধনের নাম পাঠায় সরকার। কিন্তু রাজভবন তার পরেও কমিশনার হিসাবে কারও নামে ছাড়পত্র দিচ্ছিল না। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, কমিশনার পদে তৃতীয় নামও চাওয়া হয় নবান্নের কাছে। যদিও সরকারের শীর্ষ মহল সেই নাম না পাঠানোর সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। তার পরেই গত ৭ জুন রাজীবের নামে অনুমোদন দেন রাজ্যপাল বোস। কাজে যোগ দিয়েই রাজীব ঘোষণা করেন, রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে ৮ জুলাই। এ বার সেই রাজীবেরই যোগদান রিপোর্টে সই না করে, তা ফেরত পাঠানোয় নতুন করে টানাপড়েন তৈরি হল।

এই পরিস্থিতিতে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, রাজ্যপাল যা-ই করুন না কেন, কোনও অবস্থাতেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে রাজীবকে তাঁর পক্ষে সরানো সম্ভব নয়। কারণ, রাজ্যপালের অনুমোদনের পরেই তিনি কমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে কমিশন একাধিক বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে রাজীবের নামে। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্টে নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে যে সমস্ত মামলা হচ্ছে, তাতেও রয়েছে কমিশনার রাজীবের নাম। অন্য দিকে, নতুন নিয়োগের আগে কমিশনার হিসাবে রাজ্য সরকার কয়েক জনের নাম সুপারিশ করেছিল রাজ্যপালের কাছে। সেই নামের মধ্যে কোনও একটিকে নিজের পছন্দ হিসাবে বেছে নেওয়ার কথা রাজ্যপালের। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। রাজ্যপালের সম্মতি নিয়েই রাজ্য সরকার নির্বাচন কমিশনার পদে রাজীবকে বসিয়েছে। তাঁকে একতরফা ভাবে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা সাংবিধানিক ভাবে রাজ্যপালের নেই বলেই ওই অংশের মত। ওই সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, কমিশনারের যোগদান রিপোর্ট রাজ্যপালের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। যদি কমিশনার পদ থেকে রাজীবকে অপসারিত করতেই হয়, সে ক্ষেত্রে সংসদের দুই কক্ষ, লোকসভা ও রাজ্যসভায় ৫০ জন করে সংসদের সমর্থন নিয়ে ‘ইমপিচমেন্ট’ প্রস্তাব আনতে হবে। সেই ‘ইমপিচমেন্ট’ প্রস্তাব নিয়ে সংসদের দুই কক্ষে আলোচনার পর দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের সমর্থন নিয়ে তা পাশ করতে হবে। এর পর সেই প্রস্তাবটি পাঠাতে হবে রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতি সেই প্রস্তাবে স্বাক্ষর করলে তবেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে সরানো যেতে পারে রাজীবকে। অথবা রাজীবকে নিজে থেকে ইস্তফা দিতে হবে পদ থেকে। যে কথা হাই কোর্ট বুধবার তার পর্যবেক্ষণে বলেছে।

তবে রাজ্যের বিরোধীরা এ ক্ষেত্রে হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণকেই অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘কমিশনার আদৌ পদে থেকে পঞ্চায়েত ভোট পরিচালনা করতে পারবেন কি না সে বিষয়ে মতামত দেবেন সংবিধান বিশেষজ্ঞেরা। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করতে গোড়া থেকেই রাজীব সিংহ ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা মনে করি, তিনি আর রাজ্য কমিশনার পদে থাকার যোগ্য নন। কারণ, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রাজ্যের ৮ জন নিরীহ মানুষ শাসক দলের সন্ত্রাসের বলি হয়েছেন।’’ রাজ্য বিজেপিও রাজ্যপালের এমন সিদ্ধান্তে সন্দিহান। তাদের একাংশের মতে, রাজ্যপালকে যে নামের তালিকা পাঠানো হয়েছিল রাজ্যের তরফে, সেখানে রাজীব ছাড়াও অন্য নাম ছিল। রাজীবের নামে যে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব সম্মত নন, তা রাজ্যপালকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিল বিজেপির তরফে। ওই অংশের মতে, সেই সময় এই বিষয়ে কর্ণপাত না করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় প্রাক্তন মুখ্যসচিব রাজীবের নামে সিলমোহর দিয়েছিলেন রাজ্যপাল। এখন আর নাম পরিবর্তনের সুযোগ রাজ্যপালের নেই বলেই তাঁদের মত। এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘এ ভাবে হয়তো রাজীবকে খানিকটা চাপে ফেলা যাবে। কিন্তু তাতে লাভের লাভ কিছুই হবে না।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy